কক্সবাংলা ডটকম :: চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক খাতে রয়েছে তারল্য সংকট। অস্থিরতা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। গত ২৮ কার্যদিবসে পুঁজিবাজারের সূচক কমেছে ৫৯২ পয়েন্ট। রফতানির গতিও শ্লথ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ, চলতি বছরের একই সময়ে যা নেমেছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চপর্যায়ে। সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমেছে।
ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বা অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অর্থনীতির গতি শ্লথই থাকছে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা ভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সরকারের আমদানি পরিসংখ্যানে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৬ অক্টোবর ‘মডিফাই’ করা ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট সেপ্টেম্বর, ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে পণ্য আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৬২৭ কোটি ডলার। আগস্টে যা কমে হয়েছে ৫২২ কোটি ২৭ লাখ ডলার।
একই প্রতিবেদনে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের আমদানির প্রক্ষেপণও দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্রের অর্থমূল্য হতে পারে ৪৬৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। অক্টোবর ও নভেম্বর—দুই মাসেই ঋণপত্র খোলা হতে পারে কমবেশি ৪৬৭ কোটি ডলারের। অর্থাৎ আমদানিতে প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়বে।
প্রতিবেদনে এ প্রক্ষেপণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর প্রান্তিকে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার প্রক্ষেপণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের একই সময়ের প্রক্ষেপণ ১৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় কম।
একই সময়ে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির সম্ভাব্য দায় দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত ডিলারদের (এডি) বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুদের ৫১ দশমিক ৮৩ শতাংশের সমান। এ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের মধ্যে রয়েছে নস্ট্রো অ্যাকাউন্টের নিট ব্যালান্স, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট (ওবিইউ) বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালান্স।
বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের নেতারা বলছেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতি এক ধরনের মন্থরতার মধ্যে রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে, মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি প্রায় স্থবির, যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে নতুন বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ। ব্যবসায়ীরা এখন অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের অবস্থানে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিবেশের স্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যতের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, ‘এখন অর্থনৈতিক মন্দা আছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি একেবারেই কমে গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে তেমন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। সবাই একটা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অ্যাপ্রোচ নিয়ে আছে।
তারা ভাবছে আগে নির্বাচন হোক, নির্বাচনের পর পরিবেশের ওপর নির্ভর করবে যে আমরা ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করব কি করব না। ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি, কিছু কিছু হচ্ছে। যেসব জায়গায় এরই মধ্যে সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল, সেসব জায়গায় হচ্ছে।
তবে নতুন করে কেউ কোনো প্রকল্প নিচ্ছে বলে তো মনে হয় না। বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুনতে পাই যে প্রতিটি খাতে চাহিদা কমেছে, বাড়ছে না। কারণ এখনো মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। সবাই একটু বুঝেশুনে খরচ করছে। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। মানুষের ডিসপোজেবল ইনকাম আগের মতো নেই, কমেছে। সবাই সতর্ক, বুঝেশুনে খরচ করতে চাইছে।’
একই ধরনের মতামত জানিয়েছেন দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন নেতারাও। তারা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা আস্থার সংকটে ভুগছেন।
তাদের দাবি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে ব্যবসার গতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন, তাই সরকারের উচিত দ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে আমদানির জন্য ১১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ১০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় বেশি।
একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ এলসি খোলা বেড়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি বেড়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। আমদানির এ প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে আগামী মাসগুলোয় রফতানি কিছুটা বাড়তে পারে, যদিও টানা দুই মাস রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল।
তবে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার গতি এখনো মন্থর, কারণ ব্যবসায়ীরা এখনো আস্থা ফিরে পাননি। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে, তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে ব্যবসায়িক আস্থা ও পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানির ধারাবাহিক পতন অর্থনীতির স্থবিরতার একটি স্পষ্ট সংকেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্ষেপণ ইঙ্গিত করছে যে বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি কমে গেছে। তারা সতর্ক করেছেন, আগামী প্রান্তিকে অর্থনীতির গতি আরো মন্থর হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমদানির পরিমাণে ধারাবাহিক হ্রাস অর্থনীতির গতি সম্পর্কে একটি উদ্বেগজনক বার্তা বহন করে।
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমদানির পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ কমার প্রক্ষেপণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্দা ভাবকে ইঙ্গিত করছে। সাধারণত একটি দেশে আমদানি কমলে ধরে নেয়া হয়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ সংকটে নিয়ন্ত্রিত আমদানি হচ্ছে।
এটি দেখায় যে বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ ও সক্ষমতা দুই-ই কম, যার ফলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ বাস্তবতায় আগামী প্রান্তিকে অর্থনীতির গতি আরো মন্থর হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।’
সেলিম রায়হান আরো বলেন, ‘এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু কার্যকর নীতিগত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। প্রথমত, বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারকে স্বল্পমেয়াদি কর-সুবিধা, সহজ ঋণপ্রাপ্তি ও আমদানি-সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে, বিশেষত কাঁচামাল ও শিল্প যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির জন্য মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে সমন্বয় এনে জনগণের হাতে ব্যয়ক্ষম অর্থ তুলে দিতে হবে, যেন তারা ভোক্তা হিসেবে সক্রিয় হয়।
তৃতীয়ত, ব্যবসার আস্থার সংকট নিরসনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ব্যবসায়ীদের আশঙ্কামতোই চলমান অর্থনৈতিক মন্দা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে তুলতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞদের মতামত, সাম্প্রতিক আমদানিপ্রবণতা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অর্থনীতি ক্রমেই মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
তাদের দাবি, এখনই নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি, যাতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে এলে সরকার দ্রুত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কেমন তার ওপর নির্ভর করে আমদানি।
সব ধরনের পণ্য—যেমন মূলধনি পণ্য, বিভিন্ন ধরনের মধ্যবর্তী পণ্য বা ইন্টারমিডিয়েট গুডস, ভোগ্যপণ্য—এ তিন ক্যাটাগরি বিশ্লেষণে দেখা যাবে, যখন বিনিয়োগ বাড়ে তখন মূলধনি পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পায়। আবার উৎপাদন বাড়লে মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পায়।
আর মানুষের চাহিদা বাড়লে ভোগ্যপণ্য আমদানি বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অর্থনীতি যত বেশি চাঙ্গা হবে, আমদানি তত বেশি বাড়বে। প্রক্ষেপণে দেখা যাচ্ছে, আগামী মাসগুলোয় আমদানি বাড়বে না, বরং কমবে; অর্থাৎ অর্থনীতি আরো বেশি ডিপ্রেসড হওয়ারই আশঙ্কা। বর্তমানে বিনিয়োগ বাড়ছে না। যেহেতু সামনে নির্বাচন, পরিবেশটা বিনিয়োগবান্ধব নয়। উদ্যোক্তারা বর্ধিত বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না বা হবেনও না।
যার ফলে মূলধনি পণ্যের আমদানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উৎপাদনেও একই অবস্থা। জুলাইয়ের আগে যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে অর্থনীতি।
এসব কারণে প্রক্ষেপণে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি আরো মন্দা ভাবের দিকে যাচ্ছে। আগের তুলনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো কমবে। সামগ্রিকভাবে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরো বেশি নিচের দিকে নামার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’
এ পরিস্থিতির সমাধান নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর উল্লেখ করে ড. মোস্তফা কে মুজেরী আরো বলেন, ‘অর্থনীতি রাজনীতির বাইরে কিছু নয়। বর্তমানে যে পরিস্থিতি—রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামনে নির্বাচন, অনিশ্চিত পরিবেশ—যতক্ষণ পর্যন্ত এ পরিবেশটা স্বাভাবিক না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম।
মূল কথা হচ্ছে, অর্থনীতিকে ধরে রাখার জন্য, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুতিগুলো নিতে হবে যাতে নির্বাচন হয়ে গেলে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
এখন নতুন করে অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু প্রস্তুতিগুলো নিয়ে রাখতে হবে। এতে যে সরকারই আসুক, অর্থনীতিকে মেরামত করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো দরকার সেগুলো যেন দ্রুত গ্রহণ করে যত দ্রুত সম্ভব অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা নিতে পারে।’
Posted ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta