কক্সবাংলা ডটকম :: ব্যাংকে সুদের হার কম, এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের নিশ্চিত মুনাফা হাতছাড়া করতে চাইছেন না সাধারণ মানুষ। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতে হঠাৎ করেই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উল্লম্ফন দেখা গেছে। বিদায়ী অর্থবছরে পুরোটা সময়জুড়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ছিল ভাটার টান। কিন্তু নতুন অর্থবছরের শুরুতে এ চিত্র পাল্টে গেছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে বেড়েছে নিট বিনিয়োগের পরিমাণও।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এসেছে। আগের বছরের একই মাসে নিট বিক্রি ছিল মাত্র ৩৯৩ কোটি টাকা। এর মানে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় এবার নিট বিক্রি বেড়েছে ৮ গুণের চেয়েও বেশি।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের আয় কমে গেছে। তা ছাড়া মুনাফার ওপর কর হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পর সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে যায়। ব্যাংকগুলোতে এখন সুদহার কম। বড় অঙ্ক আর দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় না হলে তিন থেকে চার শতাংশের বেশি সুদ দিতে চাইছে না তারা।
ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আরও বেশি লাভজনক হতে পারে। তবে সেখানে ঝুঁকিও ব্যাপক। এটিও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে চলার এক কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ, আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। এর মধ্যেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর। এই কঠিন সময়ে মানুষ টাকা পাচ্ছে কোথায়? বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের বিনিয়োগের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে আর আগের মতো লাভ হয় না। পুঁজিবাজারও তলানিতে। ফলে অন্য যেকোনো সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেহেতু বেশি, সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়া নির্বাচনী বছরে অন্যান্য খাতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন অনেকে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও বিনিয়োগ বাড়ছে।
নিয়ম অনুযায়ী আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট ৭ হাজার ৮৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪ হাজার ৬১০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৭ হাজার ১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র জমা বা বিক্রি করেছিল। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি ৩২ টাকা। সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট ঋণ ছিল ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।
গত অর্থছর ২০২২-২৩ (জুলাই-জুন) পুরো সময়জুড়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে ভাঙানো হয়েছে বেশি। ওই সময়ে ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করেছে ৮৪ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ২৯৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা সরকার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে। গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে এনেছে সরকার। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম।
সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ করতে চায় না। এ জন্য নানা কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে। এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার।
তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।
