কক্সবাংলা ডটকম(২৩ মার্চ) :: সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের সামান্য উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সামান্য উত্থানে কমেছে লেনদেন। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। ডিএসইতে ২৮৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৪১ কোটি ৫১ লাখ টাকা কম। এর আগেরদিন লেনদেন হয়েছিল ৩২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার।
পুঁজিবাজারে লেনদেনে এমন খারাপ অবস্থার কারণ বিদেশি বিনিয়োগ না থাকা এবং ফ্লোর প্রাইসে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার আটকে থাকা।
সূত্র জানায়,লেনদেনে গতি ফেরাতে এবং যাদের বেশি প্রয়োজন সেই সকল বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে ব্লক মার্কেটে ১০ শতাংশ কমে শেয়ার লেনদেনের সুযোগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কিন্তু সেই সুযোগকে পৌষ মাস হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। তারা মূল মার্কেটে সক্রিয় না হলেও ব্লকে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কেনার জন্য খাপ্টি মেরে বসে আছে। দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে আটকে থেকে বিরক্ত হয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করছেন। অন্যদিকে এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কম দামে শেয়ার হাতিয়ে নিচ্ছেন। যার কারণে মূল মার্কেটে যে কোম্পানির শেয়ার নামে মাত্র লেনদেন হয়, ঠিক সেই একই কোম্পানির শেয়ার ব্লকে লেনদেন হয় কয়েকশ গুণ বেশি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানকি বিনিয়োগকারীরা একদিকে ব্লকে শেয়ার কেনার জন্য বসে থাকে। অন্যদিকে ব্লক মার্কেটে কমদামে শেয়ারগুলো মূল মার্কেটে বিক্রির প্রেসার দিয়ে থাকে। যার কারণে দিনের পর দিন শেয়ারবাজারে সেল প্রেসারের কারণে ক্রেতা শূণ্য থাকে। এতে করে বাজারে চিত্র কোনভাবেই পরিবর্তন হচ্ছেনা।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাদের এমন সেচ্ছাচারিতা শেয়ারবাজরকে সামনের দিকে আগাতে দিচ্ছেনা। তারা বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার বদলে বাজারকে পেছনের দিকে টেণে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ইচ্ছা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনিচ্ছার কারণে বাজারে পতন লেগেই আছে।
তাই ব্লক মার্কেটে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কেনা বেচা বন্ধ না করলে বাজারে সেল প্রেসার টানা লেগেই থাকবে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর দেওয়ার সময় এসছে বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
অপরদিকে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। গত আড়াই বছর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এক টাকাও বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো অতীতে যে বিনিয়োগ এসেছিল, সেগুলোও বিক্রি করে দিয়ে টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারের যে বেহাল দশা তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশাও একটি কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি কমে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে নেমে আসে মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়। অর্থাৎ ওই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যতো বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, তার থেকে প্রায় ২৭ কোটি ডলার বেশি চলে যায়।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরেও সেই ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকে; বছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ২০ কোটি ডলারের মতো ঋণাত্মক হয়। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পুঁজিবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্যই বলছে, গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।
অথচ দেশে সার্বিক বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। দুই বছরের করোনা মহামারির পর এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো হোঁচট খেলেও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৩০৬ কোটি ৬০ লাখ (৩.০৭ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের এই সাত মাসে ২৭৩ কোটি (২.৭৩ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই সাত মাসে দেশে নিট এফডিআই বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ১৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ১২৯ কোটি ডলার।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪.৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছিল আরও বেশি, ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই এসেছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগে। সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন তারা। বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। কিন্তু এই ইতিবাচক ধারার মধ্যে পুঁজিবাজারে বিদেশি না আসায় হতাশ হয়েছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে চলা বাজারের মন্দাবস্থাই এর কারণ বলে মনে করছেন তারা।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো। আমাদের বাজারেও তেমনটাই ছিল। কিন্তু ২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর ৪-৫ বছর বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। ২০১৫ সাল থেকে কিছুটা আসতে শুরু করে। মাঝে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভালোই বিনিয়োগ করেছিল। ২০২০ সালে বাজারে যে একটা ধস হয়েছে সে আতঙ্কে অনেকে চলে গেছে। আর আসেনি। এখন সামান্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, সেটা আগে বিনিয়োগ করা। বাজার সুস্থ-স্বাভাবিক না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না বলে জানান তিনি।
বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশা নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘২০২১ সালের প্রথমার্ধে কিছুদিন আমাদের বাজার ভালো ছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছিল; বেশির ভাগ শেয়ারের দাম চড়া ছিল। ওই চড়া বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করেনি। বরং মুনাফা তুলে নিতে হাতে থাকা শেয়ারগুলোই বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপর থেকে বাজারে আর নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। সে কারণে নিট বিনিয়োগ অনেক দিন ধরে নেগেটিভ রয়েছে।’
আন্তর্জাতিক বড় বড় বাজারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসলে অনেক কিছু চিন্তা করে বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অডিটসহ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্টক এক্সচেঞ্জের পারফর্মমেন্স ইত্যাদি। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে আমাদের পুঁজিবাজার দুই মাসের বেশি বন্ধ ছিল। এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পছন্দ করেনি। মূলত সে সময়ের পর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করেনি।’ তবে এখনো কয়েকটি ভালো কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে বলে জানান স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, ‘প্রথম প্রথম যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন সেটা করেছেন মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। এক বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ৮৬ টাকার ডলার এখন ১০৭ টাকায় উঠেছে। সব দেশেই ডলারের বাজার অস্থির থাকলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। কেননা, ডলারের দাম বেশি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার বিক্রি করেন তখন তারা আগের চেয়ে কম পরিমাণ ডলার নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের বাজারে সেটাই হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় নতুন কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু বিনিয়োগ আসতে পারত। কিন্তু পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইজ থাকার কারণে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।’
২০১০ সালের মহাধসের এক দশক পর ২০২০ সালের ১৭ মে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। এরপর বাজার চাঙা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। মাঝেমধ্যে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। দিন যত গেছে বাজারের অবস্থা ততই খারাপ হয়েছে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ; লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। বুধবার দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৩২৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে; প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬ পয়েন্টের বেশি। মাঝে এই বাজারে লেনদেন ২০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল।
দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রোড শোর আয়োজন করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক ফল এখনো বাজারে পড়তে দেখা যায়নি।
টানা তিন দিন বন্ধ থাকবে দেশের শেয়ারবাজার। সাপ্তাহিক ছুটি এবং স্বাধীনতা দিবসের ছুটি উপলক্ষে তিন দিন বন্ধ থাকবে শেয়ারবাজার।
তিনদিন বন্ধের পর আগামী সোমবার (২৭ মার্চ) থেকে শেয়ারবাজারে নিয়মিত লেনদেন হবে।
জানা গেছে, আগামী ২৪ মার্চ (শুক্রবার) ও ২৫ মার্চ (শনিবার) সরকারি ছুটি। এরপর ২৬ মার্চ (রোববার) স্বাধীনতা দিবসের দিনের ছুটি।
এ নিয়ে তিন দিন ছুটি থাকবে সরকারী অফিস, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার। তবে হজ ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে আগামী শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যাংক খোলা থাকবে।
আগামী ২৭ মার্চ, সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেন যথারীতি শুরু হবে।
Posted ১০:১২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta