কক্সবাংলা ডটকম(১০ নভেম্বর) :: শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর বাইরে ওয়াটারফ্রন্টের কিনারে রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্রেন। নতুন এক কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্ট নির্মাণের কাজে ব্যবহার হচ্ছে এগুলো। চীনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হচ্ছে এ কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্ট। ১৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্টে হোটেল-মেরিনা যেমন আছে, তেমনি আছে মোটর রেসিং ট্র্যাকও। পাশে বড়সড় এক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দক্ষিণ দিকে নির্মাণ হয়েছে বিশালায়তনের এক বন্দরও।
চীনকে ঠেলে পেছনে ফেলার তাগিদে আঞ্চলিক শক্তি ভারতও এখন জোরেশোরে শ্রীলংকায় বন্দর নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। নিজ ভূখণ্ডের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে ও বিশ্বের ব্যস্ততম নৌপরিবহন রুটে অবস্থিত দেশ শ্রীলংকার চীনের মিলিটারি আউটপোস্ট হয়ে ওঠার আশঙ্কাই এখন ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয়।
শ্রীলংকায় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার নেপথ্যে রয়েছে দেশটির ওপর ভারত এবং চীনের বিনিয়োগ ও আধিপত্যের লড়াই। শ্রীলংকার সরকারি কর্মকর্তা ও বিদেশী কূটনীতিকরা জানান, প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও বরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে যেসব কারণে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে ভারতের স্বার্থকে এখানে কতদূর রক্ষা করা হবে, সে প্রশ্নটিও রয়েছে।
রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে চীনপন্থী রাজনীতিবিদ মাহিন্দা রাজাপাকসেকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় গত ২৬ অক্টোবর। বিক্রমাসিংহে জানান, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গত মাসের এক ক্যাবিনেট সভায় জাপান-ভারতের এক জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানকে কলম্বো বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দেয়া নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক হয়।
তিনি বলেন, ক্যাবিনেট বৈঠকে এ নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছিল। এ সময় পরিস্থিতি কখনো কখনো বেশ উত্তপ্তও হয়ে ওঠে।
প্রেসিডেন্টের নাম উল্লেখ না করেই বিক্রমাসিংহে বলেন, ভারত ও জাপানকে যেন এ কাজ না দেয়া হয়, সেজন্য বৈঠকে একটি পেপারও উত্থাপন করা হয়।
তিনি আরো জানান, এ সময় তার বক্তব্য ছিল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যাতে ভারত, জাপান ও শ্রীলংকার মধ্যে সই হওয়া এক সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) প্রতি সম্মান দেখানো হয়।
১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে আসলে কী হয়েছিল, এটিই ছিল তার প্রথম কোনো বিবরণ।
বিক্রমাসিংহের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, চীন ও ভারতের মধ্যকার বিবাদের কারণেই তাকে বরখাস্ত হতে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন কিনা। তবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তবে বৈঠকে যে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল, ওই বৈঠকে উপস্থিত সাবেক মন্ত্রী রাজিতা সেনারত্নেও তা নিশ্চিত করেছেন।
শ্রীলংকার দুই সরকারি কর্মকর্তা, এক পশ্চিমা কূটনীতিক ও ভারত সরকারের এক সূত্রের কাছে ওই বৈঠকের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তারাও।
অন্যদিকে গত সোমবার এক জনসমাবেশে সিরিসেনা বলেন, ভারতবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার রাজনৈতিক বিরোধীরা ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার শ্রীলংকার উন্নয়ন কার্যক্রমে সহায়তা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অন্যদিকে শ্রীলংকায় সরকার বদলের কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে গত সপ্তাহেই এক বিবৃতি প্রকাশ করে কলম্বোর চীনা দূতাবাস। দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্তের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে যোগাযোগ করার পর জাপানের কাছ থেকেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিক্রমাসিংহে ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কলম্বোর এক রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য প্রদেয় ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ-সহায়তার অর্থ আটকে দিয়েছে টোকিও।
কলম্বোয় ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ে দ্বিতীয় আরেকটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পাওয়ার জন্য শ্রীলংকাকে চাপ দিয়ে আসছিল ভারত। ২০১৭ সালের এপ্রিলে শ্রীলংকা স্বাক্ষরিত আরেকটি এমওইউতেও এর ইঙ্গিত দেয়া ছিল।
ওই এমওইউর কিছু অপ্রকাশিত নথি অনুযায়ী, এতে বেশকিছু প্রকল্পের ব্লুপ্রিন্ট রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্ট থাকার কথা। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, সড়ক, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কনটেইনার টার্মিনাল। এছাড়া ভারতের সহযোগিতায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন উন্নয়ন প্রকল্পের কথাও উল্লেখ রয়েছে সেখানে।
রাজিতা সেনারত্নে জানান, ওই ক্যাবিনেট সভায় বন্দর প্রকল্পে অনুমোদন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার বক্তব্য ছিল, শ্রীলংকা এরই মধ্যে চীনের কাছে ৮০০ কোটি ডলার দেনা রয়েছে। দেশটির পক্ষে আর কোনো নিজস্ব সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়।
ভেঙ্গে দেয়া মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন সেনারত্নে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেদিনকার বৈঠকে ভুল বোঝাবুঝি হয়। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ছিল, কলম্বোর ওই টার্মিনালটি উন্নয়নের কাজ রাষ্ট্রায়ত্ত শ্রীলংকা পোর্ট অথরিটির হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। সংস্থাটি এরই মধ্যে টার্মিনাল ফ্যাসিলিটি উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
বন্দর প্রকল্পটি নিয়ে বিরোধ দৃশ্যমান হওয়ার আগে থেকেই সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেবা খাতে বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়ার মতো প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ আটকে দিয়েছিলেন তিনি।
শ্রীলংকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ওই দেশের অন্যতম, যেখানে চীন-ভারত সংঘাতের কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জল ঘোলা হয়েছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো দেশগুলোয় বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করে আসছে চীন। এ অঞ্চলের বড় একটি অংশ চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। এশিয়া ও এর বাইরের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে চীন।
মালদ্বীপে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনে চীনপন্থী রাজনীতিবিদদের পরাজয় বরণ করে নিতে হয়। এ নির্বাচনের ফলাফলকে আখ্যা দেয়া হয় দ্বীপরাষ্ট্রটি নিয়ে চীনের উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের পথে বাধা হিসেবে।
কলম্বোর ওই ক্যাবিনেট সভা নিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তিনি জানতে পেরেছেন বৈঠকে সিরিসেনা মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের গত মাসে দেয়া এক বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, চীন ‘ঋণ কূটনীতির’ আশ্রয় নিয়েছে এবং দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত হাম্বানটোটা বন্দর চীনের ফরওয়ার্ড মিলিটারি বেজ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ক্যাবিনেট সভায় সিরিসেনা বলেছিলেন, শ্রীলংকা কখনোই এভাবে আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে চায়নি। বহিরাগত কোনো পক্ষের হাতে কলম্বো বন্দরের কাজ তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে এ সমস্যা আরো বাড়বে, যা তিনি কখনই হতে দেবেন না।
অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরি করতে গিয়ে ভারত ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা বিক্রমাসিংহের ভাষ্য ছিল, ক্যাবিনেট এরই মধ্যে বছর খানেক আগে ভারতের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দিয়েছিল।
তিনি আরো বলেছিলেন, ঋণ ভারাক্রান্ত শ্রীলংকা পোর্ট অথরিটির পক্ষে নিজ বিনিয়োগে টার্মিনালটি নির্মাণের সক্ষমতা নেই।
বিক্রমাসিংহে বলেন, এটি ভারতীয় প্রকল্প ছিল না। এর সিংহভাগের অংশীদারিত্ব ছিল জাপানের, যেখানে ভারতের ছিল মোটে ২০ শতাংশ।
বৈঠকে উপস্থিত কয়েক কর্মকর্তার দাবি, সিরিসেনা সেদিন শুধু প্রকল্পটিকে বাতিলই করেননি, বরং নয়াদিল্লির বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে সবাইকে চমকে দেন। তিনি বলেছিলেন, তাকে লক্ষ্য করে এক গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ সময় এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি।
শ্রীলংকা সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি অস্বীকার করে বলা হয়, সিরিসেনা সেদিন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থাটির নাম উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও পরে বলা হয়, এ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেছিলেন সিরিসেনা।
ওই ক্যাবিনেট বৈঠকের দশ দিনের মাথায় বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ২০০৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ব্যাপক হারে চীনা বিনিয়োগ ডেকে এনেছিলেন রাজাপাকসে। পরবর্তীতে নির্বাচনে সিরিসেনার কাছে হেরে যান তিনি। সে সময় গুজব উঠেছিল, রাজাপাকসের বিরুদ্ধে জোট গড়ে তোলায় র সহযোগিতা করেছিল।
কলম্বোয় এখন চীনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। শহরটির সমুদ্র উপকূলের একাংশ থেকে এখন আর খোলা সাগর দেখা যায় না। কারণ সেখানে এখন নতুন কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্ট নির্মাণের কাজ চলছে। এলাকাটিতে এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিশালাকৃতি বিলবোর্ড ও তারের জাল। সেখানে এখন চীনা ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডও দেখা যায়। রাজধানী কলম্বোর কাছাকাছি এটিই সবচেয়ে বড় কনস্ট্রাকশন সাইট।
সেখানে এখন ১২ হাজার চীনা নাগরিকের এক আলাদা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, যার ব্যাপ্তি বাড়ছে। অথচ কয়েক বছর আগেও সেখানে মাত্র কয়েকশ চীনা নাগরিকের উপস্থিতি ছিল। এসব চীনা নাগরিক এখন কলম্বো ও হাম্বানটোটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
ভারতের মোদি সরকার এখন এ দৃশ্যপট বদলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশটি এখন চীনা বিনিয়োগ ক্ষেত্রের পাশেই আগ্রাসীভাবে একের পর এক প্রকল্প স্থাপন করতে চাইছে, যাতে করে চীনা সামরিক বাহিনী কোনো ধরনের ফ্রি পাস হাতে না পায়।
এ বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা কর্নেল আর হরিহরণ বলেন, ভারতীয় উপদ্বীপের কাছে শ্রীলংকায় চীন যে কৌশলগত সুবিধা হাতিয়ে নিতে পেরেছে, ভারতের পক্ষে তা উপেক্ষা করা সম্ভব না।
ভারতের মনোযোগ শুধু কলম্বো বন্দরেই সীমাবদ্ধ নয়। হাম্বানটোটায় চীনা বন্দরের কাছাকাছি নির্মিত এক বিমানবন্দরেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে ভারত। যদিও এ বিমানবন্দর দিয়ে খুব বেশি ফ্লাইট ওঠানামা করে না।
এ বিষয়ে ভারত সরকারের এক সূত্র জানায়, আমরা খেলায় ভালোভাবেই নেমেছি। যদিও আঞ্চলিক সংবেদনশীলতার কারণে তা খুব একটা প্রকাশ করা হয় না।
Posted ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১০ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta