কক্সবাংলা ডটকম :: পতন রুখতে একাধিক পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার দর। খোলাবাজারে আবারও তেতে উঠেছে ডলার। ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য গেল কয়েক মাস কম ছিল। তবে হঠাৎ করে আবারও এলোমেলো সবকিছু।
ব্যাংকগুলোতে ডলারের বিক্রয় মূল্য ১০৯ টাকা থেকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। খোলা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়। এর আগে মুদ্রানীতি ঘোষণায় ডলারের বাজারভিত্তিক দাম নির্দিষ্ট করতে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বাজারে স্থিতিশীলতা নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন চলতে থাকলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ওদিকে, ব্যাংকে ডলারের মজুত কম, এর দাম নির্ধারণ ও বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকও ভ্রমণকারীদের কাছে ডলার বিক্রি করছে না। ফলে ডলার কিনতে তারা খোলা বাজারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, ‘ডলার বাজার বর্তমানে চড়া হওয়ার কথা না। আমাদের নির্ধারিত দরে বিক্রি করার জন্য তাদের বলা হয়েছে। মানি চেঞ্জাররা ঘোষিত হারের তুলনায় বেশি অর্থ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন শিকদার বলেন, ‘ডলার বাজারে ফ্লোটিং বিক্রেতারা বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে। গত কয়েক দিন ধরেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে।
আজও সারা দিন ডিজিএফআই, এনএসআই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ বাজারে মনিটরিং করেছি। সেখানে বেশি দামে ফ্লোটিং অবস্থায় ডলার কেনাবেচা করছে এমন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তবে নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামেই ডলার বিক্রি করছে।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ব্যাংকে বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার রয়েছে। তারপরও কেন মানুষ খোলাবাজারে যাচ্ছে? সাধারণ মানুষকে অবশ্যই খোলা বাজারের পরিবর্তে ব্যাংকে আসতে হবে। তবে খোলাবাজারেও যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দর না মানে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রাজধানীর মতিঝিলে বেশ কয়েকটি মানি চেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার তারা ১১৬ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে ১১৭ টাকায় ডলার বিক্রি করছেন। আর মঙ্গলবার ১১৭ থেকে ১১৮ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
মতিঝিলের যমুনা মানি চেঞ্জারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল ১১৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছেন তারা। এত দাম কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘হঠাৎ করেই ডলারে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু ডলার মিলছে সেটাও চড়া দামে কেনা হচ্ছে। ১১১-১১২ টাকায় কিনতে চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না। এক ডলার কিনতে ১১৫/১১৬ টাকা গুনতে হচ্ছে। এরপরও ডলার মিলছে না।
মানুষ বেশি ডলার কিনছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘চাহিদা অনুযায়ী ডলার অনেকে কিনতেই পারছে না। অনেকে দুই-তিন দিন আগে বলে রাখছেন। তখন ডলার কিনে তাদের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। ডলার বাজারে সিন্ডিকেট আছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদারকি চলছে বলে জানান তিনি। প্রতিদিন বিভিন্ন মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করছেন কেন্দ্রীয় বাংকের পরিদর্শন দল।
গুলশানের লর্ড মানি একচেঞ্জে কথা বলে জানা গেছে, হঠাৎ করে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বেশি হলেও সরবরাহ কম। অনেকে বিদেশে ভ্রমণের জন্য গেছেন। আবার শিক্ষার উদ্দেশে অনেকে বিদেশে গেছেন। তাদের প্রায় সবাই নগদ ডলার সঙ্গে করে নিয়েছেন। ফলে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। কেনার ক্ষেত্রে দাম পড়ছে বেশি। এজন্য বিক্রিও হচ্ছে চড়া দামে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ‘৫০০ ডলার চাইলেও তারা দিতে পারছে না। কারণ ব্যাংকগুলোতেও ডলারের সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বিক্রিও হচ্ছে কম। ১০০ বা ২০০ ডলার দেয়া যাচ্ছে। বিদেশফেরত নাগরিকরাই সাধারণত ব্যাংকে নগদ ডলার সরবরাহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। যেসব ব্যাংকের খুচরা গ্রাহক বেশি, তারা কিছু ডলার পাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই ডলারও পাওয়া যাচ্ছে না।’
এর আগে গত বছর জুলাই-আগস্টে সংকটের সময়ে খোলাবাজারে ডলারের দর সর্বোচ্চ ১২১ টাকায় উঠেছিল। এরপর ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠনকে (এবিবি) ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়। পাশাপাশি নগদ ডলারের দামও নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মঙ্গলবার এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের এক ডলার কিনতে লেগেছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়। এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দর অনুযায়ী রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দর ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ১০৯ টাকা। আর আমদানি নিষ্পত্তিতেও ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। তবে, এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে। এ জন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কবে থেকে সংকট শুরু
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলারসংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে একের পর এক কঠোরতা আরোপ করতে থাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন কড়াকড়ির ফলে আমদানি কমলেও ডলারসংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো দরে ডলার বিক্রি করে। এরপর ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
Posted ৪:১৬ অপরাহ্ণ | বুধবার, ৩০ আগস্ট ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta