কক্সবাংলা ডটকম(৩০ জুন) :: ইরান গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে এক আলোচিত নাম। পশ্চিমা অবরোধে জর্জরিত শিয়া প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিবেশীরাও দেশটিকে ধরাশয়ী করতে মুখিয়ে আছে। তাদের সবার অভিযোগ ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছে, যা তাদের জন্য হুমকি। যদিও বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ইরান।
অন্যদিকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলও দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এক ইরানকে বধ করতে মাঠে নেমে নতুন নতুন রণকৌশল সাজিয়ে চলেছে সৌদি জোটসহ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানে ভারতকে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রসঙ্গ আসছে কেনো? আসলে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি জোট ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধাচারণ নতুন কিছু নয়। সবকিছু সামলে নিজের মত করে বাণিজ্য ও তেল রপ্তানি করে আসছিল তারা।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক পশ্চিমা দেশ ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। ভারত একসময় দেশটির পাশে থাকলেও নিষেধাজ্ঞার ফলে তারাও তেল আমদানি থেকে সরে আসে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বারাক ওবামার প্রশাসন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করে।
২০১৫ সালের জুনে তেহরানের সঙ্গে পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতিগোষ্ঠীর ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভারতসহ আবারও বিশ্বের অন্যান্য দেশ ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি শুরু করে। ইরান থেকে তেল আমদানিতে চীনের পরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। আস্তে আস্তে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ধকল উঠতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রটি।
কিন্তু গত ৮ মে ইরানের বিরুদ্ধে সমঝোতা ক্ষুণ্নের অভিযোগ তুলে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্লান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চুক্তি কার্যকর রাখতে প্রতি তিন মাস পরপর দেশটির প্রেসিডেন্টের সম্মতি দরকার। ১২ মে পরবর্তী তিন মাসের জন্য এই চুক্তিতে ট্রাম্প স্বাক্ষর না করায় যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে সমঝোতা ভেস্তে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কেবল চুক্তি থেকে বেরিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি; যে রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য বজায় রাখবে তাদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে।
কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ইরানকে আস্বস্ত করে বলেছেন, তারা শুধু জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকেই অনুসরণ করবে। কোনও দেশের একক নিষেধাজ্ঞায় তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে না।
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকেও এ বিষয়ে আস্বস্ত করেছেন ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সবকিছুই দ্রুত পাল্টে যায় গত বৃহস্পতিবার (২৮ জুন)। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে ভারত সফরে এসে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন।
নিকি হ্যালি এক বিবৃতিতে আরো বলেছেন,কোন দেশের সঙ্গে নয়াদিল্লি বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি বা অবনতি ঘটাবে তা আরও একবার ভেবে দেখা দরকার। ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। সেই অস্ত্র দিয়ে কী করতে পারে তা সবাই বুঝতে পারছে। সারাবিশ্ব এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সহমত। তাই ভারতেরও উচিত এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ইরানের সঙ্গে তেল বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। আলোচনাও হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর নিকি হ্যালি বলেছেন, ইরান হলো পরবর্তী উত্তর কোরিয়া। তার মানে উত্তর কোরিয়ার উপর যেভাবে একের পর এক অবরোধ আরোপ করে পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করে ‘নিরীহ’ চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়েছে, তেমনি ইরানকেও করা হবে।
নিকি হ্যালির এ বক্তব্যের পর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে শুরু করেছে ভারতের অবস্থান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের বিভিন্ন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারতের তেলমন্ত্রী তাদের ইরান থেকে তেল আমদানি শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন।
কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশ একপাশে এবং যুক্তরাষ্ট্র একা একপাশে অবস্থান করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে ইরান থেকে তেল আমদানি না করে সেটা সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার পরিকল্পনাও শুরু করা হয়েছে!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে সুষমা স্বরাজ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতিসংঘকে মেনে চলে ইরান থেকে তেল কেনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটার কী হবে? এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য যদিও এখনো পাওয়া যায়নি, তবে বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা তারা রক্ষা করবেন না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ আসলেই যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে ভারতের পক্ষে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যক সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়; জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা চীন-রাশিয়া তাদের পক্ষে থাকলেও। কারণ ভারত কেবলই তার বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকে নজর রাখবে। ফলে নিজেদেরকে ‘অবিশ্বাসী’ বন্ধু হিসেবেই ইরানের কাছে পরিচিত হবে ভারত।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা ইরানকে যেভাবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে নিকি হ্যালি তুলনা করেছেন। বিষয়টি মোটেও তেমন সরলীকরণ নয়। কারণ ইরানের যে শাসন ব্যবস্থা, সেখানে ধর্মীয় নেতারা মোটেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করবে না। বরং সেটার চেষ্টা হলে দেশটির প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রেভ্যুলেশন গার্ডকে দিয়ে রুহানির সরকারকে ক্ষমতা চ্যুত করতে পরেন।
একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে পারেন। শুরু হতে পারে মধ্যপাচ্যে আরেক ভয়াবহ যুদ্ধও। সবমিলে ইসরায়েল, সৌদি জোটকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রথ এখন ইরান বধে সংকল্পবদ্ধ।
এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করে ভারত হল সেই রথের অদৃশ্যমান আরেক অবিশ্বস্ত সারথী!
বিবিসি, রয়টার্স ও দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
Posted ৫:১৪ অপরাহ্ণ | শনিবার, ৩০ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta