দীপন বিশ্বাস :: আরসার অন্যতম প্রধান কমান্ডার এবং অর্থ শাখার প্রধান (ক্যাশিয়ার) মোঃ করিম উল্লাহ প্রকাশ মাষ্টার কলিম উল্লাহ ও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির অন্যতম দেহরক্ষী আকিজ’সহ চারজন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার করা হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া থানাধীন ঘোনারপাড়াস্থ ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশনের ব্লক-৫ এর হাউজ নং-৩ থেকে র্যাব-১৫ তাদের গ্রেফতার করে। এসময় ০১টি বিদেশী পিস্তল, ০১টি এলজি, ০৭টি ককটেল, ০৫ রাউন্ড এ্যামুনিশন এবং ১২বোর ০১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১৫ সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা’র সদস্যরা কক্সবাজারের উখিয়া থানাধীন ঘোনারপাড়াস্থ ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশনের ব্লক-৫, হাউজ নং-৩ এ পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্দেশ্যে অবস্থান করছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৩ মার্চ মধ্যরাতে র্যাব-১৫, কক্সবাজার এর একটি আভিযানিক দল উক্ত স্থানে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে।
এ সময় র্যাবের উপস্থিতি বুঝতে পেরে দিক-বিদিক দৌড়ে পালায়নের চেষ্টাকালে আভিযানিক দল চারিদিক থেকে ঘেরাও করে সেখান থেকে বর্তমানে বাংলাদেশে আরসার অন্যতম প্রধান কমান্ডার এবং অর্থ শাখার প্রধান (ক্যাশিয়ার) মোঃ করিম উল্লাহ প্রকাশ মাষ্টার কলিম উল্লাহ ও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির এক সময়কার অন্যতম দেহরক্ষী আকিজ’সহ চারজন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন আরসার প্রধান কমান্ডার ও অর্থ বিভাগের প্রধান করিম উল্লাহ প্রকাশ মাস্টার,সংগঠনটির প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির দেহরক্ষী মো. আকিজ,অর্থ বিভাগের সহযোগী মোহাম্মদ জুবায়ের এবং গান গ্রুপের সদস্য সাবের হোসেন ওরফে মৌলবি সাবের।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। গ্রেফতারকৃত মোঃ করিম উল্লাহ প্রকাশ মাষ্টার কলিম উল্লাহ সপরিবারে ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় রাস্তার পাশে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে সপরিবারে ক্যাম্প-১২ তে গিয়ে বসতী নির্মাণ করে অস্থায়ীভাবে বসবাস এবং সেখান থেকে ক্যাম্প-২০ এ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
সে ক্যাম্প-২০ এ বসবাসের সুবাদে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাম্প-২০ এর আরসা জিম্মাদার মৌলভী ইয়াসিনের মাধ্যমে আরসায় যোগদান এবং আরসার সাথী সদস্য হিসেবে কাজ করতে থাকে। সে ২০২০ সালে পার্শ্ববর্তী দেশে আরসার প্রশিক্ষণ শেষ করে বাংলাদেশে পুনরায় প্রবেশের পর ক্যাম্প-২০ এর এম/৩৩ ব্লকের জিম্মাদার এবং আরসার হয়ে হত্যা ও চাঁদাবাজি সহকারে নানান ধরণের অপকর্মের ফলশ্রুতিতে তাকে ক্যাম্প-২০ এর হেড জিম্মাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে সে ক্যাম্পে আরসার সদস্য বৃদ্ধি সহকারে তার নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। তার নেতৃত্বে ১৬ সদস্যসের একটি অস্ত্রধারী গান গ্রুপ পরিচালনা করতো।
আরসার অস্ত্রধারী গান গ্রুপের সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তাঁরকাটার বাহিরে বাংলাদেশের পাহাড়ে অবস্থান করে থাকে। রাতের আঁধারে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘঠিত করে আরসা সন্ত্রাসীরা সকাল ৭/৮ টার পূর্বেই ক্যাম্প ত্যাগ করে পুনরায় পাহাড়ে অবস্থান নিতো। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নির্দেশে মায়ানমার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ টেকনাফের খারাংখালী এবং উনচিপ্রাং সীমান্ত হয়ে গ্রেফতারকৃত মাষ্টার কলিম উল্লাহ’র নিকট আসতো।
পরবর্তীতে সকল ক্যাম্পের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সে নিজেই আরসা ক্যাম্প কমান্ডারদের নিকট হস্তান্তর করতো। অতঃপর ক্যাম্প কমান্ডাররা অস্ত্র-গোলাবারুদ আরসা কিলার গ্রুপের মাঝে সরবরাহ করতো। এছাড়াও মাষ্টার কলিম উল্লাহ বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী ও সদরের ভারুয়াখালী এলাকা এবং টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দেশীয় অস্ত্র বিক্রেতাদের নিকট হতে নগদ অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ ক্রয় করতো বলে জানা যায়।
সাম্প্রতিককালে আরসা সন্ত্রাসী সমি উদ্দীন, সালমান মুরব্বী, মাষ্টার ইউনুছ, মাষ্টার কামাল ও রহিমুল্লাহ মূসা’সহ আরসার বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য কমান্ডাররা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ায় গ্রেফতারকৃত মোঃ করিম উল্লাহ প্রকাশ মাষ্টার কলিম উল্লাহ বাংলাদেশে আরসার প্রধান কমান্ডার হিসেবে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতো। সে বিভিন্ন সোর্স হতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মাইন ও বিষ্ফোরক তৈরীর সরঞ্জাম সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আরসার গোপন আস্তানা ও গহীন পাহাড়ে নিয়ে যেতো। পরবর্তীতে মাইন ও বিষ্ফোরক তৈরীর পারদর্শী আরসা সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ধরণের মাইন, বোমা ও বিস্ফোরক তৈরী করতো। তৈরীকৃত এ সকল বিস্ফোরক রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন স্থানে আতংক সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এর নির্দেশে আরসার আধিপত্য বিস্তার করার জন্য মাষ্টার কলিম উল্লাহ এর নেতৃত্বে আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অগ্নিসংযোগ করে অরাজকতা সৃষ্টি করতো।
২০২৩ সালের প্রথমে আরসার সামরিক শাখার প্রধান খালেদের নির্দেশে গ্রেফতারকৃত মাষ্টার কলিম উল্লাহ বাংলাদেশে আরসার অর্থ সংগ্রহকারী (ক্যাশিয়ার) হিসেবে দায়িত্ব পায়। মায়ানমারে অবস্থানকারী আরসা কমান্ডার মৌলানা লাল মোহাম্মদ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা মাস্টার কলিম উল্লাহর নিকট পাঠাতো।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ গ্রেফতারকৃত মাস্টার কলিম উল্লাহ কর্তৃক বাংলাদেশে হতে পার্শ্ববর্তী দেশে ট্রেনিং এ গমনকারী আরসা সদস্যদের যাতায়াত খরচ বাবদ ৫০০ থেকে ১,০০০/-, প্রশিক্ষণরত সদস্যদের পরিবারকে প্রতি মাসে ৫,০০০/-, ট্রেনিং শেষে পরবর্তী ৬ মাস ৩,০০০/- এবং যারা বাংলাদেশে বিভিন্ন মামলায় জেল হাজতে থাকে তাদের পরিবারকে প্রতি মাসে ৩,০০০/- করে প্রদান করতো। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সদস্যদের ভাতা হিসেবে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আরসার অন্যান্য জিম্মাদারদের মাধ্যমে মাষ্টার কলিম উল্লাহ বিতরণ করতো। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ০৮টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত মোঃ আকিজ ২০১৭ সালের প্রথম দিকে মায়ানমার হতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে উনচিপ্রাং সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং ক্যাম্প-৭ এ বসবাস শুরু করে। সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে বসবাস করতো। সে ২০১৬ সালে মায়ানমার থাকাকালীন সময়ে আরসায় যোগদান এবং একই বছর নভেম্বর মাস হতে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির অন্যতম দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া সে আরসার অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের সাথে আরসা প্রধানের পক্ষ হতে বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতো।
পরবর্তীতে মায়ানমার হতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চট্টগ্রামে বসবাসকালে সে আরসা নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতো এবং চট্টগ্রাম হতে আরসার জন্য লজিষ্টিক সামগ্রী সহকারে বিভিন্ন মালামাল প্রেরণ করতো বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ০১টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত মোহাম্মদ জুবায়ের ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের পর আরসা নেতা মাষ্টার জোবায়ের এর মাধ্যমে আরসায় যোগদান এবং ক্যাম্প-১৩ এর পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ পায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে আরসার প্রধান কমান্ডার ও অর্থ শাখার প্রধান মাষ্টার কলিম উল্লাহ তার আপন চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে সে তার একান্ত সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এই সময়ে সে মাষ্টার কলিম উল্লাহ এর নির্দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন হত্যাকান্ড, চাঁদাবাজি, অগ্নি সংযোগ সহকারে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে সরাসরি অংশগ্রহন করতো। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ০১টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত সাবের হোসেন প্রকাশ মৌলভী সাবের ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ক্যাম্প-২২ এ বসবাস এবং ইবনে আব্বাস মসজিদে (ক্যাম্পে মসজিদ) ইমামতি শুরু করে। সে আরসার নেট গ্রæপের সদস্য ছিল। সে আরসার সন্ত্রাসীদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করতো এবং আরসার সদস্যদের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আরসার গান গ্রুপের ক্যাম্পে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতো বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য এ পর্যন্ত র্যাব-১৫, কক্সবাজার সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেল এর প্রধান, স্লীপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডার এবং লজিস্টিক শাখার প্রধানসহ সর্বমোট ১০৩ জন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত আরসা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সর্বমোট ১০টি বিদেশী অস্ত্র, ৫২টি দেশীয় অস্ত্র, ১৪৪ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ৫০.২১ কেজি বিস্ফোরক, ২৮ পিস ককটেল, ০৪ পিস আইইডি, ১.৫ কেজি মার্কারী (পারদ) এবং ০৪টি হাত বোমা উদ্ধার করা হয়।
Posted ১০:৩৬ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta