কক্সবাংলা ডটকম(১৯ জানুয়ারী) :: খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের আবার বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ছোট অঙ্কের ঋণ নবায়ন, নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট নিয়ে মাঝারি অঙ্কের ঋণ এবং কিছু শর্তে ফেলে বড় অঙ্কের ঋণগুলো নবায়ন করা হবে।
খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত কঠোর নিয়ম আরোপ না করে অনেকটা সহজভাবে বিবেচনা করা হবে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই কৌশল নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এর ফলে ব্যাংকিং খাতে নতুন করে আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে না। উল্টো আগের যেসব খেলাপি ঋণ রয়েছে সেগুলোর পরিমাণও ধীরে ধীরে কমে আসবে। এতে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতাও কমে আসবে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। এসব ঋণ আদায় ও নবায়নের উদ্যোগ এখন চলছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কিছু টাকা ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, সত্যিকার অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত। সেসব বিষয়ে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়। এটা মানবিক কারণেই করতে হয়। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে। বাইরে কিছু করা হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, এই প্রক্রিয়ায় যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান রয়েছে কিন্তু খেলাপির কারণে নতুন ঋণ পাচ্ছেন না, তাদের সহজ শর্তে ঋণ নবায়ন করে দেয়া হবে। একই সঙ্গে দেয়া হবে নতুন ঋণ, যাতে ব্যবসা চালু রেখে ঋণ পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু শর্ত দেয়া হবে এরপর খেলাপি হলে নবায়নের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি প্রয়োগ করা হবে। ছোট ঋণখেলাপিদের এই প্রক্রিয়ায় নবায়ন করে দেয়া হবে। ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
বড় ও মাঝারি মানের যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে ব্যবসা সচল রাখতে পারছেন না তাদের উদ্ধার করার জন্য ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হবে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো নিজ ক্ষমতায় যেগুলো পারবে সেগুলো তারা নিজেরা করবে। বাকিগুলোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ নেবে। তবে এই প্রক্রিয়া যাতে ব্যর্থ না হয় সে বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করবে ব্যাংকগুলো।
উল্লেখ্য, গত ১০ জানুয়ারি বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতারা নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। এরপর গত রোববার বিএবির নেতারা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ওই বৈঠকেও তারা খেলাপি ঋণ কিভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে কথা বলেছেন। এমডিরা খেলাপি ঋণ কমাতে কিছু ক্ষেত্রে নমনীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রচলিত আইন সংশোধন এবং আদালতে মামলাজট কমানোর ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন।
এরপর বিএবির নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। পরে নিজ নিজ ব্যাংকের নির্বাহীদের সঙ্গেও আলাদা আলাদাভাবে বৈঠকে বসেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেও তারা আলাদাভাবে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন। এর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, প্রথম দফায় খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে ১০ শতাংশ, দ্বিতীয় দফায় ২০ শতাংশ এবং তৃতীয় দফায় ৩০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতেও খেলাপি ঋণ নবায়ন করা যায়। এই ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট কত হবে সেটিও নির্ধারিত হয় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এর আলোকে এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ করেও খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা চাচ্ছেন কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়ন করার সুযোগ।
এছাড়া কৃষি খাতের খেলাপি ঋণ কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার রয়েছে। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কৃষকদের এ সুযোগ দেয়া হলেও এবার স্বাভাবিক অবস্থায়ই নির্বাচনের আগে গত ডিসেম্বরে এ সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, এসব উদ্যোগের পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এর মধ্যে বেসরকারি এজেন্টেদের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের জোরদার চেষ্টা করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাস্তবসম্মত কারণে কেউ ঋণখেলাপি হলে তাকে ছাড় দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে কোনোভাবে ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে তাকে ধরা উচিত। গণহারে খেলাপি ঋণ নবায়ন করলে সাময়িক খাতা পরিষ্কার হলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা থেকেই যাবে। এতে ক্ষতি আরও বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে তদারকি বাড়ানো হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব। এর আগে ২০১১ সালে ও ২০১৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছিল। ওই দুই বছরে ঋণ প্রবাহ বাড়ার পরও খেলাপি ঋণ বাড়েনি, বরং কমেছে। ২০১১ সালে ২০১০ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ কমে ৬৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে খেলাপি ঋণ কমেছে দুই হাজার ১৪২ কোটি টাকা। ওই সময়ের মতো তদারকি করা হলে এ বছরও খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, খেলাপি ঋণ নবায়ন ব্যাংকের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখন দেখে-শুনেই ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে।
Posted ৩:৪৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২০ জানুয়ারি ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta