কক্সবংলা ডটকম(৭ মার্চ) :: জাতির পিতা ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম দিক হচ্ছে তাঁর বক্তৃতা। তাঁর প্রতিটি কথাই ধমণীকে শিহরিত করে তোলে। বোধকে শাণিত করে।
অ্যারিস্টটল একবার বলেছিলেন, কথাই মানুষের মনজয়ের প্রধান অস্ত্র। বাঙালি জাতির হাজার বছরের অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পটভূমি থেকে শুরু করে সম্বোধন, স্বরের ওঠানামা ও উপমা এক স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছিল।
বিশেষ করে বক্তব্যের সময় বঙ্গবন্ধুর আঙুলের ব্যবহার ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উপস্থাপন ভাষণকে ধারালো করেছে। সেই বক্তৃতা হলো বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির এক মহামন্ত্র।
যখন তিনি বললেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- তখনই জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আবেশ তৈরি হয়। যে আবেশ নতুন মানচিত্রের জন্য নিজেকে উৎসর্গ হতে অনুপ্রাণিত করে।
একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়- বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার মধ্যেই নিহিত ছিল স্বাধীনতার বীজ। তিনি নিজেই বলেছেন, আমাদের বাঁচার দাবি হচ্ছে ৬ দফা কর্মসূচি।
সে সময় তিনি অকপটে বলেন, ‘এদেশের মানুষের ভালোবাসাকে সম্বল করে আমি যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি।’
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে জ্বলে ওঠে ক্ষোভের আগুন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠক শেষে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘৭ কোটি বাঙালির কল্যাণে আমি সবকিছুই উৎসর্গ করব।’সেদিন থেকেই বাংলার প্রতিটি জনপদে স্লোগান ধ্বনিত হতে থাকে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
পরদিন অর্থাৎ ২ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ছাত্র-জনতার একটি বিশাল সমাবেশে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা। ৩ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হয়। এর সঙ্গে চলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত অসহযোগ আন্দোলন। তবে বঙ্গবন্ধু সে সময় বলেছিলেন, জনগণকে যে কোনো ত্যাগে প্রস্তুত থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু সবাইকে হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।
৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালিত হয়।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আগামী ৭ মার্চ দুপুর ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণ দান করিব। সেখানেই আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করিব।’ তবে এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও টঙ্গীতে স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন বিপুলসংখ্যক মানুষ।
৭ মার্চের আগের দিন আওয়ামী লীগের জরুরি বৈঠক বসে। বৈঠকে ৭ মার্চের বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়।
অবশেষে আসে ৭ মার্চ। মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে রেসকোর্স ময়দানে এলেন তিনি। লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির মহাপুরুষ বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এই ঘোষণাকে বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘোষণা হিসেবে। স্বাধীনতা যুদ্ধ তো বটেই, আজও বঙ্গবন্ধুর সে ঘোষণা বাঙালিকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে। সেদিনের মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। সেদিন প্রতিটি মানুষের ও মিছিলের গন্তব্য ছিল একটাই- রেসকোর্স ময়দান।
পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি। বসন্তের বৃক্ষশোভিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশু পার্কের জায়গায় গাছে গাছে সবুজ কুড়ি উঁকি দিচ্ছিল। একাত্তরের এই দিনেই অঙ্কুরিত হয়েছিল বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী :
এদিকে বুধবার ঐতিহাসিক ‘৭ মার্চ’ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির জন্য পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। পুরো বাঙালি জাতি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবগাহন করেছিল রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতা। মাত্র ১৮ মিনিটের এই মহাকাব্যে ধ্বনিত হয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মহামন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর শাণিত ও প্রদীপ্ত উচ্চারণে কেঁপে উঠেছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের মসনদ। মূলত ৭ মার্চের ভাষণেই নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল শোষণমুক্তির কাংখিত পথ।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দেশের শাসনভার জনগণের হাতেই তুলে দেন। সেই মর্মস্পর্শী বজ্রনিনাদ ৭ কোটি বাঙালির হৃদয়কে বিদ্যুৎগতিতে আবিষ্ট করেছিল। রাজনীতির কালজয়ী মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ভাষণের মাধ্যমে দেশের শাসনভার জনগণের হাতেই তুলে দেন, ক্ষমতাকে কী করে নিয়ন্ত্রিতভাবে সবার কল্যাণে ব্যবহার করতে হয় তাও বুঝিয়ে দেন।
শিখিয়ে দেন আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধক সমরনীতি, যুদ্ধকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে শহিদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন।’
এই মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি গভীর শ্রদ্ধায় প্রথমেই স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ, দু’লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে-যাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
Posted ১:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ মার্চ ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta