ইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম(১৬ আগস্ট) :: কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (ক উ ক) হাটি হাটি করে যাত্রালগ্নের আজ ২য় বর্ষ পূর্ণ হল।প্রকৃতির অপার দানে মহিমান্বিত কক্সবাজার। পাহাড়, টিলা, দ্বীপ, নদী, সাগর, সমতল ভূমি ও বিশ্ববৃহৎ বালিয়াড়ি সৈকতের অপূর্ব মিলন মেলার তীর্থ ভূমি কক্সবাজার। অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী, নানান বর্ণ, ধর্ম, জাত-পাত মানুষের বৈচিত্রময় জীবনধারা, বহুজাতিক নৃ-তাত্বিকতা, পুরানো স্থাপত্য-শিল্প এবং প্রাকৃতিক সম্পদে বলীয়ান বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব জেলা রূপসী কন্যা কক্সবাজার। এমন অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দয্যের মহামিলন শুধু বাংলাদেশেই নয়, আমার ভ্রমন জীবনে পৃথিবীর কোথাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি।
তবে আমরা যারা এই মাটির সন্তান, অধিকাংশই এই মধুর মিলন যজ্ঞের নির্যাসকে অনুধাবন করতে অপারগ নিজস্ব বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতা এবং অদূরদর্শিতার কারণে। আর তাই বৃটিশ শাসন পরবর্তী পাকিস্থান ও বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রারম্ভেও কক্সবাজারকে প্রকৃত অর্থে বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্যকর স্থান এবং পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কক্সবাজারকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, শত ব্যর্থতার জাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয়ে কক্সবাজারকে নান্দনিকতার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত করতে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই লক্ষ্যে কক্সবাজার পৌরসভা ও সংলগ্ন বিশেষ পর্যটন অঞ্চলকে নিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা এবং বিশেষ পর্যটন অঞ্চল আইন (৩১নং আইন) হিসেবে ঘোষিত হয়। তারই প্রেক্ষিতে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ২০১১-২০১৩ সালে কক্সবাজারের জন্য সীমিত আকারে মহাপরিকল্পনা প্রনয়ন করে।
বস্তুত: সরকার গঠনের প্রারম্ভ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগ সরকারের আন্তরিকতা ও প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন সাধুবাদ যোগ্য। সুতরাং আধুনিক ও পর্যটন নগরী প্রতিষ্ঠানকল্পে ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিল ২০১৫’ মহান জাতীয় সংসদে ৬ই জুলাই ২০১৫ সালে পাশ হয়। তাহা ১৩ মার্চ ২০১৬ সালে মাননীয় রাষ্ট্রপতির সস্মতি লাভ করে এবং ৭নং আইন হিসেবে সর্ব সাধারণের অবগতির জন্য বাংলাদেশ গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর এভাবেই প্রকৃত কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) এর জন্ম। তবে উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিলো নামে মাত্র। তার কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে।
যা হোক, পরিশেষে ১১ আগষ্ট ২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) এর ১ম চেয়ারম্যান হিসেবে লে: কর্ণেল (অব;) ফোরকান আহমদ, এলডিএমসি, পিএসপি নিয়োগ লাভ করেন। তার ক’দিন পর ১৭ আগস্ট ২০১৬ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের উপ্িস্থতিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার সমর্পণ করেন।
উক্ত সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জেলার মাননীয় সাংসদবৃন্দ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উক্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান কৌশলীসহ উচ্চ স্তরের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদস্থ নেতৃবৃন্দ, সামাজিক এবং পেশাজীবি ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। যে জন্য দিনটি আজ ঐতিহাসিক।
এখানে জনসাধারণের প্রশ্নহেতু একটি বিষয়ের অবতারণা করতেই হয়। কক্সবাজার পৌরসভার অস্তিস্থ থাকতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর প্রয়োজনীয়তা কেন? অথবা একটি প্রতিষ্ঠান অন্যটির পরিপূরক কিনা? এমন অনেক ধরনের প্রশ্ন। আমাদের জ্ঞাত থাকা দরকার যে, বর্তমান সরকার দেশে বিভাগীয় শহরের বাইরে শুধু মাত্র কক্সবাজারকেই ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা ও উন্নীত করেছে। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন যথাযত ও বাস্তব সস্মত। বস্তুত, কোন পৌরসভার বহুমুখী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল সমৃদ্ধ নয় বিধায় কক্সবাজারে পৌরসভা বিদ্যমান থাকা সত্বেও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন অত্যাবশ্যক।
শুধু কক্সবাজার পৌরসভাই নয়, জেলার বিশেষ পর্যটন অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল, এবং জেলার অন্যান্য পৌরসভা ও সংলগ্ন অঞ্চল সমূহ কউক এর উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এলাকা হিসেবে পরিগণিত। অর্থাৎ কুতুবদিয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, রামু ও টেকনাফের বিশেষ এলাকা সমূহ এখানে অন্তর্ভূক্ত। প্রকৃতপক্ষে কউক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিরিখে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। আর উক্ত বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্ট পৌরসভাগুলো তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে কউক হচ্ছে প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ এবং পৌরসভা হচ্ছে সেই প্রকল্প বা এলাকা সমূহের তদারকি বা লালন পালন কর্তৃপক্ষ। এতে দু’ কর্তৃপক্ষের মাঝে কোন আইনগত, উন্নয়ন সংক্রান্ত বা সস্মান-অসম্মান বিষয়ক কোন বিরোধ নেই। একে অপরের পরিপূরক। কক্সবাজারের নান্দনিক উন্নয়নে দু’টো প্রতিষ্ঠানই সরকার পরিচালিত সেবামুখী, উন্নয়নমুখী এবং দায়িত্ববান।
কক্সবাজর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামক সদ্যজাত শিশু প্রতিষ্ঠানটি কক্সবাজারের ইতিহাসে মাইল ফলক। প্রশ্ন থেকে যায়, কউক এর বিশাল স্বপ্ন ও কর্মযজ্ঞের উন্নয়নে আমরা যারা এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি তারা কতটুকু দায়িত্ব ও কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হয়েছি? অথবা সফল না ব্যর্থ? কক্সবাজারবাসীর অবগত থাকা দরকার যে, বর্তমান কউক এর যাত্রা শুরু হয় মূলতঃ শূন্য থেকে। জেলা প্রশাসন থেকে দায়িত্ব গ্রহণের সময় কিছু ফাইল ও কিছু কাগজপত্র ব্যতিত ছিলো না কোন অফিস। ছিলো না চেয়ার, টেবিল, প্রয়োজনীয় কোন অফিস সামগ্রী, গাড়ি এবং কোন জনবল। বর্তমান চেয়ারম্যান মহোদয় ও আমরা দিন-রাত নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছি যাতে দ্রুত অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় এবং কউক এলাকার জনগণকে উন্নয়ন কাছে সেবা প্রদান করা যায়।
আমরা সবাই অবগত যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি অফিস কার্যক্রম জটিল প্রক্রিয়াজাত ও ধীরগতি সম্পন্ন। তারপরেও মন্ত্রণালয় সমূহের আমলাতান্ত্রিকতার কঠিন পথ অতিক্রম করে ২ বছরের শেষান্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদিত হয়েছে, দেশের অন্যান্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে তুলনামূলক বিচারে। বিষয় সমূহ এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা অবাস্তর ও অসম্ভব। তবে সময়ই বলবে, সময় অনুপাতে আমাদের কর্মের ব্যর্থতা ও সফলতা।
কউক এর বিশেষ আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, দালান বা স্থাপনা নির্মাণ অনুমোদন প্রদান। অনুমোদন প্রাপ্তির ব্যাপারে অভিযোগের শেষ নেই। অধিকাংশ ভূক্তভোগীদের দাবী, নির্মাণ বিধিমালার আইন অমান্য ব্যতয় করে হলেও কউক কর্তৃক প্লানের অনুমোদন প্রদান করা হোক। তারা আগের পৌরসভা এবং জেলা প্রশাসক কর্তৃক পরিচালিত কউক এর অনুমোদনের মতো অনুমতি চান। এভাবে চলমান অনিয়মতান্ত্রিকতার কারনে কক্সবাজার শহর এলাকাকে পরিবেশ সম্মত শহর হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশেষত: সংর্কীণ সড়ক, নালা ও বর্জ্য অব-ব্যবস্থাপনা সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান। বাস্তব সত্য যে, আমরা কক্সবাজারবাসী সরকার কর্তৃক নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক বাড়ি নির্মাণে অভ্যস্থ ছিলাম না। বর্তমান কউক বাংলাদেশ সরকার প্রণীত নির্মাণ বিধিমালা যথাযথ মানতে বাধ্য করছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ১০০ টি অধিক প্ল্যান অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। আশা করি, পরিবেশ সন্মত পর্যটন শহর গড়ে তুলতে অতি শীঘ্রই প্ল্যান অনুমোদন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে বাড়ী বা স্থাপনার অনুমোদন প্রত্যাশী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
অতি আনন্দের বিষয় যে, কউক এর মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয় এবং সকল সন্মনিত র্বোড মেম্বারদের আন্তরিক ও নিরন্তর প্রচেষ্টার বদৌলতে ইতিমধ্যেই ক উ ক এ ২২০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় চুড়ান্ত প্রক্রিয়াধীন আবস্থায় আছে। এতদব্যতিত প্রথমিক পর্যায়ে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক উ ক কাজ করছে।
প্রকল্পগুলো হচ্ছে : ১) পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রনয়ন ২) কউক এর ১০ তলা অফিস ভবন নির্মাণ ৩) পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরে ৪টি স্থানে সৌন্দয্য র্বধন স্থাপনা ৪) কক্সবাজার শহরস্থ ঐতিহ্যবাহী লালদিঘী, গোলদিঘী ও বাজারঘাটা পুকুরের সংস্কার সাধন ও উন্নয়ন ৫) হলিডে মোড় থেকে কক্সবাজার লারপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কের উন্নয়ন ও প্রশস্থকরন। ৬) কলাতলী সড়কে কউক এর বহুতলা বিশিষ্ট বানিজিক ভবন ৭) কক্সবাজার সদরে কউক এর আবাসিক ফ্লাট উন্নয়ন প্রকল্প-১ ৮) কক্সবাজার সদরে কউক এর আবাসিক ফ্লাট উন্নয়ন প্রকল্প-২ ৯) সুগন্ধা মোড় থেকে বীচ সড়ক হয়ে লাবণী মোড় পর্যন্ত সড়কের প্রশস্থকরন ও সংস্কার। ১০) কুতুবদিয়ায় পর্যটন বান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ।
এখানেই আমাদের পথচলা শেষ নয়। সেই অদম্য লক্ষ্যে আগামী অনাগত সময়ে আমাদের হৃদয়ের গহীনে প্রোতিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। কক্সবাজার পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিদ্যুত বিভাগ, পানি উন্নয়ন র্বোড, গণপূর্ত বিভাগ ও বনবিভাগ সহ সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে সমম্বয় সাধন করে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পথ চলা হোক শুভ, সুন্দর এবং ডিজিটাল সমৃদ্ধ পরিবেশ বান্ধব কক্সবাজার। সর্বোপরি এক কথায় বলতে চাই, আজকের কক্সবাজার হবে উন্নত দেশের আধুনিক পর্যটন ও স্বাস্থ্যকর স্থানের মত স্বপ্নীল শহর।
লেখক-ইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম:
বোর্ড মেম্বার, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগ।
সেক্রেটারী, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটশন, কক্সবাজার উপ-কেন্দ্র।
Posted ৬:১০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta