
কক্সবাংলা রিপোর্ট :: কক্সবাজার জেলার অর্থনীতিতে পর্যটন বড় অবদান রাখছে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানা কারণে পর্যটন নগরীটি কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক বিদেশী পর্যটক টানতে পারছে না। কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স, ঢাকার (সিসিএডি) এক জরিপে অংশ নেয়া ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন সেখানকার পর্যটক নিরাপত্তা দুর্বল।
শনিবার ১৮ই অক্টোবর রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘কক্সবাজারের উন্নয়ন যাত্রার জোয়ারভাটা: সমস্যা, সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় জরিপের এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এতে ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী তাদের মতামত দেন। যাদের ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ পেশাজীবী ও চাকরিজীবী।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ আর ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা ছিলেন ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। জরিপে অংশ নেয়াদের অধিকাংশই কক্সবাজার জেলার স্থানীয় বা সেখানে কর্মরত ব্যক্তি। এর বাইরে দেশের অন্য জেলা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্বও ছিল।
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মত দেন, পর্যটন, নিরাপত্তা ও পরিবেশ—এ তিনটি খাতই কক্সবাজারের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছে পর্যটনের বিষয়টি। পর্যটন ও সৈকত ব্যবস্থাপনাকে জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মত দিয়েছেন ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ।
এরপর আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মত দিয়েছেন ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, সমুদ্র অর্থনীতিকে (ব্লু ইকোনমি) গুরুত্বপূর্ণ বলছেন ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং লবণ শিল্প ও কৃষি জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত বলে মনে করে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন কক্সবাজারের পর্যটক নিরাপত্তা দুর্বল। সেখানে নিরাপত্তাহীনতা (মাদকের বিস্তার, ছিনতাই ইত্যাদি) বেড়েছে।
এসবের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব (প্রভাবশালীদের স্বার্থরক্ষা) রয়েছে বলে মত দিয়েছেন ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। তবে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন সেখানে প্রশাসনের তৎপরতা বেড়েছে।
জরিপে প্রশ্ন রাখা হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারের কোন সমস্যার সমাধান করা জরুরি। এর জবাবে ৮৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোহিঙ্গা সংকট ও নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে সমাধানের পক্ষে মত দেন।
এরপর পরিবেশ সুরক্ষা ও দখলদারত্ব বন্ধের পক্ষে মত দেন ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর নাগরিক পরিষেবার (পানি, বর্জ্য, পয়োনিষ্কাশন) মান বাড়ানোর কথা বলেন ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ।
জেলাটির পরিবেশ রক্ষায় বালিয়াড়ি ও পাহাড় দখলমুক্ত করার কথা বলেছেন জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ। যানজট ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে বলেছেন ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। নদী, খাল ও জলাভূমি রক্ষার পক্ষে মত দিয়েছেন ৪৩ দশমিক ৩ ও পর্যটন শিল্পের কাঠামোগত নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।
মাতারবাড়ী প্রকল্পের সুফল ও ক্ষতিকারক বিষয়টি জরিপের প্রশ্নে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মতামত প্রদানকারীর ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ মনে করেন মাতারবাড়ী প্রকল্পের কারণে কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে করেন ৫২ দশমিক ২ শতাংশ এবং এ প্রকল্পের কারণে জমির মূল্য বেড়েছে বলে মনে করেন ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ।
তবে মাতারবাড়ী প্রকল্পের কারণে স্থানীয়দের ওপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেটিও উঠে এসেছে এ জরিপে। অংশ নেয়াদের ৮৪ দশমিক ৩ মনে করেন এ প্রকল্পের কারণে পরিবেশগত ক্ষতি (দূষণ ও জীববৈচিত্র্যের হ্রাস) হয়েছে। মৎস্য ও কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে বলে মত দিয়েছেন ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এছাড়া স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করেন ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার (বহিরাগত-স্থানীয় সংঘাত) আশঙ্কা করেন ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
সিসিএডির প্রধান সমন্বয়ক মোহিব্বুল মোক্তাদির তানিমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে কক্সবাজার-২ আসনের সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘রাষ্ট্রকে দেয়ার জন্য কক্সবাজারের অনেক কিছুই আছে।
অসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সমুদ্র অর্থনীতি ও সম্ভাবনাময় মানুষ—সবই এখানে আছে। উন্নয়নকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে এনে জনগণ ও দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। কক্সবাজার হবে আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র।
বঙ্গোপসাগরের কারণে আগামীতে কক্সবাজার দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণকেন্দ্র হবে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে আমাদের আরো গবেষণা বাড়াতে হবে।’ বঙ্গোপসাগরের নিচে থাকা খনিজ আহরণে প্রযুক্তিবান্ধব গবেষণা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা কক্সবাজারের পর্যটন নিয়েই পড়ে আছি। কিন্তু সমুদ্র সম্ভাবনা নিয়ে ততটা কাজ করিনি। আমাদের সমুদ্রে কোন ধরনের সম্পদ আছে জানি না। জানার খুব চেষ্টা করেছি বলেও মনে হয় না। আগামীতে সমুদ্র দিয়ে শুধু দেশ না, বিশ্ব শাসন করা হবে। এ সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। এখানকার মানুষ ভূরাজনীতি বোঝে না, তারা কক্সবাজার বোঝে। তবে এ কক্সবাজারে নানা সমস্যা রয়েছে। আমরা ঢাকার মতো কক্সবাজারকেও নষ্ট করছি।
এখানে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। সময়সীমা নির্ধারণ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়েই কক্সবাজার ভারাক্রান্ত। এর ওপর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এরপর হাজার হাজার পর্যটকের লোড নেয়ার মতো সক্ষমতা এখানকার প্রকৃতির নেই। সেজন্য কক্সবাজার বাঁচাতে সব নীতিনির্ধারকের সমন্বয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কক্সবাজারকে শুধু পর্যটন স্পট বানিয়ে ফেলেছি। সেখানে সাগর রয়েছে। সাগরে মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। সেসব নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতিবেশী দেশগুলো সাগর থেকে নানা খনিজ সম্পদ আহরণ করছে। কিন্তু আমরা কিছু করছি না। এখানে আরো দৃষ্টি দিতে হবে।’
এ সময় আরো বক্তব্য দেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশফাক হোসেন, সাবেক সচিব মাফরুহা সুলতানা, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সাংগঠনিক সম্পাদক এমএম সুজা উদ্দিন, এবি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাশেম, সংগঠক সাজেদুল আলম মুরাদ, ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা প্রমুখ।

Posted ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta