স্বপন চক্রবর্ত্তী
নিউইয়র্ক,যুক্তরাষ্ট্র থেকে(১৫ এপ্রিল) :: এভাবেও নববর্ষ কেটে যেতে পারে ! কে ভেবেছিল জীবনে ! ফুলবিহুর দিনে ফুলের সজ্জা নেই, বিহুর দিনে খৈ নাড়ু নেই, আটকড়াই নেই (আট রকমের উপাদান যেমন শুকনো শিমের বীচি/নানা রকম বাদাম/বুট ইত্যাদি সহ চাল ভাজা), কোথাও কোন বর্ষবরণের অনুষ্ঠান নেই, পহেলা বৈশাখের রঙিন মিছিল নেই ! কখনও কেউই কি ভেবেছিল- এভাবেও নববর্ষের দিন কেটে যাবে ! পরবাসের অনেক বছর নববর্ষের এমন কোন আয়োজনই ছিল না। বিগত কয়েকবছর নানা সংগঠনের আয়োজনে বর্ণাঢ্য নববর্ষের আয়োজন এই বিভূঁইয়েও হচ্ছে ।
বলা যায়, হচ্ছে সারা পৃথিবীরই নানা দেশে- যেখানেই বাঙালি আছে ! তবে নিউইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন, প্যারিস ও সিডনিতে এই আয়োজনের মাত্রা অনেকটাই বিপুল। সেক্ষেত্রে নিউইয়র্কের আয়োজন সবার সেরা বলা যায় । যদিও দেশের সাথে তার তুলনাও চলে না ।
দেশের অনুষ্ঠানগুলোর একটুখানি ঝলক টিভিতে দেখে প্রাণ জুড়াতে হতো আগে । এবার কিন্তু দেশেও সবকিছুই যেন সুনসান। সারা বিশ্বই যেন আজ অধিক ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে আছে ! কোথাও কেউই যেন জেগে নেই! কোথাও কারও কোন সাড়াও নেই ! সবাই যেন ভুলেই গেছে আজ নববর্ষ ! জেগে আছে শুধু ফেসবুক – ওতেই একে অন্যকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় সেরে নেয়া ! মানুষও ক্রমশ: রোবট হয়ে উঠছে, রোবটীয় জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে । প্রাণের পরশ যেন আর কিছুতেই থাকতে নেই – ভবিষ্যতেও যেন কোথাও থাকবে না প্রাণের উল্লাস জারিত আনন্দ উৎসব!
মানুষ কি অমন জীবন কখনও চেয়েছিল ? অমন নিরর্থ ব্যর্থ জীবন কোন্ মানুষই বা চাইতে পারে ! নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ মানুষ কিন্তু ক্রমশ যেন নিজের সত্তাকেই হারিয়ে ফেলছে ! আজ অফিসে প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটে গিয়ে কতক্ষণ যে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম – নিজেই জানি না। কখন যে মিটিং এর সময় হয়ে গেছে, মিটিং এও যে কি বলেছি, কি যে বলার ছিল, কিছুই তো স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিনের মতো এগিয়ে যায়নি ! এ পর্যন্ত একাশি জন সহকর্মী করোনার বলি হয়েছে । তিন হাজারেরও বেশী আক্রান্ত হয়েছে এই একটি প্রতিষ্ঠানেই। নিউইয়র্কেই মৃত্যু সংখ্যা এগার হাজার ছাড়িয়ে গেছে ।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে চোখে পড়ল এর মধ্যে তিনজনকেই তো আমি চিনি, একটা সময়ে ওরাও একই উইং এর কলিগ ছিল। অনেকদিন ওদের সাথে তারপর আর আমার কোন যোগাযোগ ছিল না, দেখাও ছিল না, ভিন্ন পরিসরে কাজের কারণে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । ওদের একজন ‘মূর’! ওর নামের অপর অংশ কেউই ডাকতো না! সবার কাছে ‘মূর’ (Moore) হিসেবেই সে পরিচিত, বলা ভাল, জনপ্রিয় । ক্রিকেট পাগল মূরের বাড়ি ছিল জ্যামাইকায়। স্বভাবত কারণেই ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাপোর্টার।
কিন্তু অবাক কান্ড হলো, ক্রিকেটের ইতিহাস ও বিগত ষাট সত্তর বছর যারাই ক্রিকেট খেলে সুনাম অর্জন করেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দলে, তাদের নামধাম, ঘটনাক্রম, খেলার স্কোর সব ওর নখদর্পনে ! অথচ, জীবনের অন্য কোন বিষয় নিয়ে তার অমন আগ্রহ নেই।
বাঙালি হিসেবে ক্রিকেট ও ফুটবল (সকার) নিয়ে উৎসাহ ও মাতামাতি আমরা ছোটবেলা থেকে কে না করেছি! তাই বলে প্রতিটা প্লেয়ারের জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়! ভারতীয় ক্রিকেটের এককালীন দলনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির জন্ম তারিখটাও আমি জানি না দেখে – সে যা’ অবাক হয়েছিল- তার সে অবাককরা মুখটি দেখে আমার নিজেরই লজ্জা হয়েছিল !
আরে কি কান্ড, সারা পৃথিবীর সব ক্রিকেট প্লেয়ারের জন্মদিনও জানা থাকতে হবে নাকি ! অষ্ফুটে সে কথা জানাতেই – সে বিস্মিত স্বরেই জবাব দিয়েছিল -‘ তার মানে হচ্ছে – তুমি ক্রিকেট পছন্দ কর এই কথা বলতে পারো, কিন্তু ক্রিকেট ভালোবাসো -এটা যেন বলো না; ভালোবাসলে তোমার সবই জানার কথা গো’!
আমার মুখে কোন কথা ছিল না আর । এরই নাম তো সঠিক ভালোবাসা আসলে। ক্রিকেট বিশ্বকাপের দিনগুলোতে সে ছুটি নিয়ে নিতো যদি কোন খেলা মিস করে এই ভয়ে । না, পরে খেলার রেকর্ড দেখলে চলবে না। তখন তো জানা হয়ে গেছে স্কোর, ওই খেলা দেখে কি মজা আর ! ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে এমন এমন উদ্ভট প্রশ্ন করতো মূর যে, ভারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়তে হতো – আর অন্যরা আমার নাকানিচুবানি দেখে হাসিতে গড়িয়ে পড়ত ।
আমি কি আর করি – রাগ দেখিয়ে মূরকে জব্দ করতাম । মূরের সাথে কেউ রাগ বা ঘোসসা করার মানে হচ্ছে, কিছুক্ষন পরে ইয়া বড়ো জায়েন্ট সাইজের কফি এনে টেবিলে রাখবে – আর বলবে, এই নাও রাগানোর মাশুল দিলাম ! এরপরে কে আর ওর সাথে রাগ করে থাকতে পারে !
আজীবন অকৃতদার মূরের জীবনদর্শনও ভারী অদ্ভূত – ওর প্রকৃতির মতোই ! নির্দিষ্ট কোন ধর্মে বিশ্বাস ছিল না মূরের, সে নাস্তিকও ছিল না। তার মতে ধর্মের ঝগড়ায় তার মন দেবার মতো সময় নেই । সব ধর্মেরই তো দাবী ওরাই শ্রেষ্ট। অথচ, মানুষের জন্যই তো ধর্মের সৃষ্টি! মানুষই এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো! মনের দিক থেকে সে ছিল সাম্যবাদে বিশ্বাসী, তবে রাশিয়া বা চীনের প্রচণ্ড সমালোচক ছিল, বলত, ওরা সাম্যবাদ বোঝেই না।
জ্যামাইকার ভূমিপুত্র মূর মূলত: পেশায় একজন শিক্ষক ছিল, কিন্তু যৌবনে আমেরিকায় এসে শিক্ষকতায় তার আর ফেরা হয়নি – ! আগ্রাসী একজন পাঠক ছিল মূর, পরে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে একটু থিতু হয় । তার জীবনের ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধু খেলা ও বিশ্ব সাহিত্য ও দর্শনে ডুবে থাকা, আর আশেপাশের সবাইকে নিজের মানুষের মতই ভালোবাসা !
সেই মূর এই করোনা বিষের শিকার হয়েছে জেনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেম, কোন কাজই হাতে উঠছে না। নিয়তি যে কখন কার গলায় খড়্গ তুলবে কেই বা জানে । দু’হাত তুলে মনে মনে মূরের আত্মার শান্তি কামনা করলাম। এতে মূরের কোন লাভ হবে কিনা তা’তো জানিনা। তবে মূরের আত্মার শান্তি হবে ভেবে নিজের মনেই শান্তি খুঁজলাম !
ভালো থেকো মূর, তুমি যেমনটি ছিলে অমনই থেকো ।
And when great souls die,
after a period peace blooms,
slowly and always
irregularly. Spaces fill
with a kind of
soothing electric vibration.
Our senses, restored, never
to be the same, whisper to us.
They existed. They existed.
We can be. Be and be
better. For they existed.
When great trees falls
——- Maya Angelou
লেখক : স্বপন চক্রবর্ত্তী,নিউইয়র্ক,যুক্তরাষ্ট্র থেকে (কক্সবাজারের রামু প্রবাসী)
Posted ২:১৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৫ এপ্রিল ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta