কক্সবাংলা ডটকম(১৬ ফেব্রুয়ারী) :: করোনাভাইরাস আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ ৬০টিরও বেশি দেশ চীনের সঙ্গে জল, স্থল ও আকাশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কমপক্ষে ১৪ দিন আগে চীন ভ্রমণ করেছেন এমন কোনো বিদেশীকে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া চীনা শিক্ষার্থীরা। আর চীনা নতুন চান্দ্রবর্ষের ছুটিতে ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার কারণে এ সঙ্কট আরো জটিল হয়েছে। কারণ এসময় শিক্ষার্থীরা লম্বা ছুটিতে দেশে পরিবার পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাতে আসেন। কিন্তু এখন ক্লাস শুরু হলেও সংশ্লিষ্ট দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা ক্যাম্পাসে ফিরতে পারছেন না।
এ পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক চীনা শিক্ষার্থীর সেমিস্টার মিস করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ দিলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে অধিকাংশই এ সুবিধা নিতে পারছেন না। যেমন, উহানের শু মিংসি (২২) নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। এ সপ্তাহেই তার ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু তিনি যেতে পারছেন না। অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ আছে কিন্তু এর জন্য বাৎসরিক ফি গুনতে হবে ৬২ হাজার ডলার। এতো টাকা দেয়ার সমার্থ্য তার পরিবারের নেই। ফলে ছয় মাসের সেশন জটে পড়ে যাবেন তিনি।
২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৯ লাখ চীনা শিক্ষার্থী বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এর প্রায় অর্ধেকই পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র অথবা অস্ট্রেলিয়ায়। এই শিক্ষার্থীরা দুই দেশের অর্থনীতিতে শত শত কোটি ডলার অবদান রাখে। এখন যদি তাদের ক্যাম্পাসে ফেরা এক বা একাধিক সেমিস্টার পিছিয়ে যায় তাহলে এই দুই দেশই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ুয়া ৩ লাখ ৬০ হাজার চীনা শিক্ষার্থীর মধ্যে ঠিক কতোজন ক্যাম্পাসের বাইরে রয়েছে সে হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। ক্যাম্পাস খোলার কয়েক দিন আগে ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। অস্ট্রেলিয়া যখন ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন মোট চীনা শিক্ষার্থীর ৫৬ শতাংশেরও বেশি ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছিল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সে হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১ লাখ ৬ হাজার ৬৮০ জন চীনা শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেনি। যেখানে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ বা মার্চের শুরুর দিকে ক্লাস শুরু হবে।
অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটি চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু সুবিধার ব্যবস্থা করছে। চাইলে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করতে ও পরীক্ষা দিতে পারে, কয়েক সপ্তাহ পরে সেমিস্টার শুরু করতে পারেন অথবা ডিগ্রি স্থগিত করতেও পারেন। অ্যালেক্স (ছদ্মনাম) নামে এক শিক্ষার্থী বলছেন, মধ্য মার্চের মধ্যে ক্যাম্পাসে ফিরতে না পারলে চলতি সেমিস্টার তাকে স্থগিত রাখতে হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে তাকে প্রতি বছর ফি দিতে হয় ৩০ হাজার ২৮০ ডলার। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে এটি অনেক বেশি।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উচ্চশিক্ষা নীতি বিষয়ের অধ্যাপক নরটন বলেন, এই যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ফিরতে পারছে না তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে উপযুক্ত একটি ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কিছু করার সামর্থ্যই নেই।
চীনা শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে ক্যাম্পাসে ফিরতে না পারলে শুধু তাদেরই ক্ষতি এমনটি নয়; এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর চলতি সেমিস্টার মিস হওয়া মানে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট রাজস্বের ২৩ দশমিক ৩ শতাংশই এসেছে বিদেশী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। যেখানে ২০১৮ সালে ভর্তি হওয়া মোট বিদেশী শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮ শতাংশেরও বেশি চীনা। সামগ্রিকভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে বিদেশী শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার!
আর ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চীনা শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল ১ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। সরকারি হিসাবেই এ পরিসংখ্যা পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক নরটন বলছেন, অস্ট্রেলিয়ায় চীনা শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে একটি ত্রৈমাসিক বা অর্ধবার্ষিক সেমিস্টার মিস করতে হবে। এর মানে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বল্পমেয়াদে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার নগদ অর্থপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থনীতির জন্য এটি বড় ধাক্কা।
এদিকে বাণিজ্য বিরোধ নিয়ে এমনিতেই মার্কিন ক্যাম্পাসের প্রতি চীনা শিক্ষার্থীর চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে সরকার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ইউসি বারক্লির সেন্টার ফর হায়ার স্টাডিজের গবেষক রাহুল চৌদাহা বলেন, এটি খুবই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত অনাগ্রহ তৈরির উপাদান হিসেবে কাজ করবে।
তবে শুধু অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে এমন নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনা করে প্রায় ৭০ হাজার চীনা শিক্ষার্থী। মার্চ থেকে নতুন সেমিস্টার শুরু হবে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবার নির্ধারিত সময়ের দুসপ্তাহ পর থেকে সেমিস্টার শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে।
অপরদিকে করোনাভাইরাস চীনের বাইরে চীনা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাবকে আরো উসকে দিতে পারে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোতে চীনা শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ক্যাম্পাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। ফলে এসব ক্যাম্পাসে চীনা শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা জটিল হয়ে উঠছে। চীনা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের গোপন তথ্য ও প্রযুক্তি চুরির জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে। বাণিজ্য বিরোধের কারণে এ সন্দেহ প্রবলতর হয়েছে।
অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাম্পাসগুলোতে চীনা শিক্ষার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তাদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এর মধ্যে যুক্ত হলো করোনা ভাইরাস। এটি হতে পারে তাদের প্রতি বিদ্বেষের নতুন মোক্ষম অস্ত্র।
সিএনএন অবলম্বনে
Posted ৭:৫৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta