
কক্সবংলা ডটকম(৩ জানুয়ারি) :: উন্নত বিশ্বে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুঁজিবাজার। কিন্তু উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। কারসাজি চক্রের খপ্পরে পড়ে রুগ্ন হয়ে হারাচ্ছে বিনিয়োগকারী। বিদেশি বিনিয়োগও কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। অথচ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে বিশে^র ৮টি দেশের ১৫টি শহরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ‘রোড শো’ করা হয়েছিল।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের এ রুগ্ন দশার জন্য দায়ী শেয়ারের দাম বেঁধে দেওয়া (ফ্লোর প্রাইস)। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। রোড শো করে বিদেশিদের সামনে শতবার বক্তব্য দিলেও বিনিয়োগকারী আসবে না। কারসাজি বন্ধ করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারলে বিনিয়োগকারী নিজ উদ্যোগেই চলে আসবে।
পুঁজিবাজারের তথ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৯টি। একই বছরের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৯টি। অর্থাৎ ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বা ৯১ হাজার ২০৬টি বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে।
শেয়ারের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে নেমেছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ধস। ২০২৩ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি হয়েছে মাত্র ২টি কোম্পানির। অথচ ২০২০ ও ২১ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়। ২০২২ সালে কিছুটা কম হলেও সেটা সদ্যবিদায়ি বছরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
বিদেশি বিনিয়োগ টানতে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ঢাক ঢোল পিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র ৮টি দেশের ১৫টি শহরে রোড শোর আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। তবে এ রোড শোর উদ্দেশ্য পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ব্যক্তি ও কোম্পানির বিনিয়োগ ২০ দশমিক ৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার বা অর্ধেক।
২০২২-২৩ অর্থবছরে যে বিনিয়োগ হয়েছে এর মধ্যে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার এসেছে বিভিন্ন বন্ডে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দৈনিক গড় টার্নওভার ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯২ কোটি টাকায়। আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, রোড শো করে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না এটা বিএসইসি নিজেই জানে। নির্দিষ্ট প্রজেক্টের আওতায় বিএসইসি রোড শো করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। বিদেশিরা বক্তব্য শুনে কখনো বিনিয়োগ করে না। তাদের সামনে শতবার বক্তব্য দিলেও কাজ হবে না।
ফ্লোর প্রাইস দিয়ে পুঁজিবাজারকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করছে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বেঁচে যাওয়া যাবে, তবে এভাবে বেঁচে যাওয়ার মানে হচ্ছে পুঁজিবাজারকে অচল করে দেওয়া। অচল বাজারে তো বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে আসবে না।
তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইস না থাকলে শেয়ারের দাম ওঠানামা করত। শেয়ার কমবেশি দামে বেচাকেনা করত। এখন তো নির্দিষ্ট দামের নিচে নামতে পারছে না। বিনিয়োগকারীরা নিজেদের প্রত্যাশিত দামে শেয়ার কিনতে পারছে না। শেয়ারহোল্ডাররা বিক্রি করতে চাইলে কম দামে বিক্রি করতে পারছে না। তবে ফ্লোর প্রাইস কারসাজি চক্রের জন্য বাধা হয়েছে এটিও ঠিক।
২০২২ সালের জুলাইয়ে করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সূচকের অবাধ পতন ঠেকাতে প্রতিটি শেয়ারের জন্য ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করেছিল বিএসইসি। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে বাজার লেনদেনমুখী করতে ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের জন্য এ ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে আবারও সব স্টকের জন্য ফ্লোর প্রাইস চালু করা হয়। এতে বেশিরভাগ স্টকের লেনদেন না হওয়ায় ফ্লোরপ্রাইস বাজারকে স্থবির করে তুলেছে।
বাজার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে লেনদেনে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসেই গড়াগড়ি খায়। এসব কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা হয় না। এ অবস্থা চলছে গত এক বছর ধরেই। ফলে শেয়ারের দাম যেমন বেশি কমছে না। তেমনই শেয়ারধারীরা কম দামেও বিক্রি করতে পারছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, সুদহার বৃদ্ধি, ডলার সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি শঙ্কা আছে। আশা করি নির্বাচনের পর শেয়ারবাজার ভালো হবে। তখন তারল্যসংকট কেটে যাবে।
এদিকে বিদেশি বিনিয়োগ কমার আরেক কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে দায়ী মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন।
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের বাজার পছন্দ করেন না যেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ আটকে যেতে পারে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও তাদের সম্পদের মূল্য কমেছে। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২১ শতাংশ। ফলে ডলারের রেট ৮৬ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০৮ দশমিক ৫০ টাকা হয়েছে।

Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta