কক্সবাংলা ডটকম(৫ ফেব্রুয়ারী) :: পাঁচ বছর আগের আজকের দিনটিতে জনতার স্বতস্ফূর্ত এক আন্দোলনের সূচনা দেখেছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলায় শুরু হওয়া গণজাগরণ নামে পরিচিতি পাওয়া এই আন্দোলনের পথ ধরেই সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে নেমে আসে লাখো জনতা।
কোনো সংঘবদ্ধ দল বা গোষ্ঠীর চেষ্টা ছাড়া এই ধরনের আন্দোলন বিরলই বলা চলে। ৯০ দশকে যুদ্ধাপরাধীরে বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনটি ছিল আরও বড়, আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক, আরও বেশি কার্যকর। এই আন্দোলনের পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসি থেকে বেঁচে যাওয়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে কুখ্যাত আরও বেশ কয়েকজন মানবতাবিরোধীর।
পাঁচ বছর পর এই আন্দোলনের সেই আবেদন আর আমেজ নেই আগের মতো। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রায় সবার দণ্ড কার্যকর, কিছু আসামির ফাঁসির দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন চলমান আছে। তবে গণজাগরণ মঞ্চ এখনও নানা দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
নারী-শিশু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হামলা, সমালোচিত আইনের বিরুদ্ধে এখনও সোচ্চার মঞ্চ। তবে আগের মতো জনসম্পৃক্ততা নেই আন্দোলনে। নিজেদের মধ্যে মত ও পথের ভিন্নতায় ভাগাভাগিও এসেছে।
এর মধ্যেও আন্দোলনের পঞ্চম বার্ষিকীতে ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে নানা কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়েছে। বেলা দুইটা থেকে শাহবাগে শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বিকাল তিনটায় জাগরণ শোভাযাত্রা, এরপর আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
আলোচনার বিষয়বস্তু ঠিক করা হয়েছে: ‘মত প্রকাশে বাঁধা, সাম্প্রতিক কানাকানুন; কোন পথে বাংলাদেশ?’।
যেভাবে শুরু আন্দোলন
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যার পেছনে কাদের মোল্লার দায় প্রমাণও হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুদণ্ডের রায় না আসায় বলতে গেলে হতভম্ভ হয়ে যায় গোটা দেশবাসী।
আর এই রায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। শুরুতে অল্প কিছু তরুণ মানববন্ধন করে জাতীয় জাদুঘরের সামনে। পরে তারা শাহবাগ মোড়ে গোল হয়ে বসে অবস্থান নেয়।
সেখান থেকে বেসরকারি টেলিভিশনে এই কর্মসূচির কথা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে থাকে। সারা ঢাকা শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসতে থাকে শাহবাগে, একটাই দাবি, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’
যে তরুণ-তরুণীরা কখনও রাজপথে এসে দাবি জানায়নি, তাদের মুখে দাবির স্লোগান শুনে এগিয়ে আসে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো। ধীরে ধীরে শাহবাগ হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার শক্তি হিসেবে।
এর আগ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করার দাবিতে জামায়াত-শিবির চক্র দেশজুড়ে নাশতকা-সহিংসতার ঝড় বইয়ে দিচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও হচ্ছিল ব্যাপক হামলা। কয়েকজনকে হত্যাও করে তারা। কিন্তু শাহবাগে ‘জনতার প্রতিরোধে’ থমকে যায় তারাও।
আর এই আন্দোলন কেবল ঢাকায় থেমে থাকেনি। ছড়িয়ে যায় দেশের প্রতিটি শহরে। সব জায়গা থেকে একসঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’
আর আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ব্যবস্থা করে জাতীয় সংসদ। আর আপিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালত ফাঁসির দণ্ড দেয় কাদের মোল্লাকে।
এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় একে একে ফাঁসিতে ঝুলেছেন জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী। আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করার সময় মারা গেছেন গোলাম আযম, আবদুল আলীম।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি দেশের মানুষের যে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে, সেটি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেই প্রমাণ হয়েছে। এর ফলে এই বিচারের বিরুদ্ধাচারণ করা জামায়াত-শিবির চক্র চুপসে যেতে বাধ্য হয়।’
তবে এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় আবার মাঠে নামে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাদের নাস্তিক দাবি করে তাদের ফাঁসির দাবিতে ঢাকা অবরোধ করে তারা। আর ওই বছরের ৫ মে পল্টন, বিজয়নগর তাণ্ডবের পর রাতে মতিঝিল থেকে হেফাজত কর্মীদের উচ্ছেদে ব্যাপক অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ওই অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানির গুজবে দেশে নানা ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য এই প্রাণহানির অভিযোগ সত্য প্রমাণ হয়নি। হেফাজত কোনো তালিকা দিতে পারেনি। আর এখন সরকারের সঙ্গে সংগঠনটির ভালো সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।
তবে ওই রাতের পরেই শাহবাগে আন্দোলনের মঞ্চ ভেঙে দেয় পুলিশ। আর এরপর থেকে দিবসভিত্তিক নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে মঞ্চ। আর এসব কর্মসূচিতে জনঅংশগ্রহণও কম।
পাঁচ বছর পর মূল্যায়ন
এটা স্পষ্ট যে, যে আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে ইতিহাস পাল্টে দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল, সেই আন্দোলন এখন জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে। নানা সময় নানা কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অংশ নেয় বটে, কিন্তু পাঁচ বছর আগে ফেব্রুয়ারির মতো জন অংশগ্রহণ আর চোখে পড়ছে না।
এই সময়ে অবশ্য নিজেদের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি ধর্মকে ব্যবহার করে আক্রমণ হয়েছে মঞ্চের প্রতি। আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা মানুষদেরকে ধর্মদ্রোহী বলে আক্রমণের চেষ্টা হয়েছে, হত্যাও করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলছেন, ‘হ্যাঁ, শুরুতে অনেক স্বতস্ফূর্ত গণ আন্দোলন ছিল। কিন্তু গণজোয়ার সব সময় এক রকম থাকে না। এটা পৃথিবীর নানা দেশে দেশেই দেখা গেছে। ফরাসী আন্দোলন চলেছিল এক সঙ্গে ১০ দিন। আমাদের এখানে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলেছে ১৭ দিন।’
-আপনারা কি এই আন্দোলনকে সফল দাবি করবেন?
এটা আমাদের দেশের তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই সফল একটি আন্দোলন, সাধারণ মানুষের ডাকে এমন আন্দোলন হয়েছে আতে গোনা কয়েকটি।
যারা শপথ নিয়েছে তারা দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। কোটি মানুষ গণস্বাক্ষর দিয়েছে। আর এই এটা সরকারের জন্য এক ধরনের চাপ ছিল, আবার জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার মধ্যে তারা সাহসও পেয়েছে।
-আন্দোলনের সাফল্য হিসেবে কোনটিকে তুলে ধরবেন?
আমাদের আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় সংসদে আইন পরিবর্তন করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ব্যবস্থার ঘোষণা আসে। এরপর সংশোধন হয় আইন। আর সে অপরাধীর (কাদের মোল্লা) প্রাপ্য শাস্তি আমরা পেয়েছি, আরও বেশ কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে।
-আপনাদের সব দাবি তো পূরণ হয়নি…
হ্যা, জামায়াত নিষিদ্ধ করা, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজেয়াপ্ত করার দাবিও আছে আমাদের।
তবে আমাদের আন্দোলন কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। হয়ত প্রতিদিন বসছি না, প্রতিদিন কর্মসূচি থাকে না। কিন্তু যখনই দেখেছি আপসকামিতা, যখনই দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে কিছু হচ্ছে, আমরা কিন্তু প্রতিবাদ জারি রেখেছি।
-কিন্তু আগের মতো জনঅংশগ্রহণ তো হচ্ছে না।
-হ্যাঁ, এটা সত্য সব কর্মসূচিতে আগের মতো মানুষ হচ্ছে না। এটা সম্ভবও না। কিন্তু এখনও বিপুল মানুষ অংশ নিচ্ছে সুনির্দিষ্ট দাবির কর্মসূচিতে। যেমন কুমিল্লায় তনু হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচিতে লাখো মানুষ অংশ নিয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলার পর সম্প্রীতি রক্ষায় রোডমার্চেও অংশ নিয়েছে লাখো মানুষ।
নানা বাধা প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করতে হয়েছে, কথনও অনেক কমে গেছে, মানুষ আবার প্রয়োজন মনে করেছে, তারাই এসেছে।
-পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনাদের এখনকার অবস্থান বা দাবি কী?
-আমাদের ঘোষিত ছয় দফা দাবি তো রয়েছেই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের পথচলা দেখতে চাই। চাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, তথা একটি ন্যয়নিষ্ঠ বাংলাদেশ। এগুলো যতদিন না চলবে, ততদিন আন্দোলন চলবে।
-আপনাদের ওপর তো ধর্মকে ব্যবহার করে আক্রমণ হয়েছে। এর ফলে মঞ্চের আন্দোলনে ভাটা পড়েছে বলেই ধারণা করা হয়।
-মৌলবাদী গোষ্ঠীর এই ধরনের আক্রমণ তো নতুন না। এ দশে যত প্রগতিশীল আন্দোলন হয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই তারা একই কার্ড ব্যবহার করেছে।
কিন্তু তারা কি সফল হয়েছে? ভাষা আন্দোলনে জয়ী হয়ে আমরা মাতৃভাষার অধিকার আদায় করেছি, স্বাধীনতার লড়াইয়েও জিতেছি। ধর্মকে ব্যবহার করে মৌলবাদী গোষ্ঠী জিততে পারেনি।
গণ জাগরণমঞ্চের আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টাতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। উগ্রবাদীরা কী বলেছে, তাদের অপপ্রচারের জন্য আন্দোলনে জনপ্রবাহ কমেছে বলে মনে করি না। বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনে আগের মতোই লাখো মানুষ আসে এখনও।
-কিন্তু মঞ্চের উদ্যোক্তাদের মধ্যেও তো বিভক্তি এসেছে…
একটা আন্দোলনে মত পার্থক্য আসেই। আমাদের তো কোনো সংগঠন নেই। কাজেই এখানে বিভক্তির কথা বলব না। যারা আমাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন তারাও তো শাহবাগ, আমরাও শাহবাগ।
আমার ভাবনার সাথে অন্যের ভাবনার মিল নেই, কেউ মনে করেছে বাংলাদেশ পরিবর্তন করবে, কেউ ভেবেছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, কেউ ভেবেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে। সবার মত ভিন্ন, পথ ভিন্ন, কিন্তু লক্ষ্য তো একটাই, আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে চাই।
Posted ৭:৩৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta