আব্দুল কুদ্দুস রানা(২৩ জুলাই) :: সকালে ফেসবুকে একটি ভিডিওচিত্র দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে কালো বোরকা পরিহিতা এক নারী যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে কয়েকজন লোক তাঁকে তাড়া করছে। হাতে লাঠি। তারপর শুরু পিটুনি। প্রাণ বাঁচতে নারীর চিৎকার, তারপর দৌড়। আশপাশে বহুলোক দাঁড়িয়ে। কেউ নারীকে রক্ষায় এগিয়ে এলেন না। সবাই ব্যস্ত মুঠোফোনে ভিডিও এবং ছবি তোলা নিয়ে। মুহুর্তে এই ভিডিও আপলোড হচ্ছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হায়রে মানুষ।
ঘটনাটা কক্সবাজারের টেকনাফ হ্নীলা বাসস্টেশনে। অনুসন্ধানে জানা গেছে-ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন প্রতিবন্ধি । তাঁর নাম চম্পা বেগম। এলাকায় তিনি ‘চম্পাবু পাগল’ নামেই পরিচিত। ‘ছেলেধরা’ অভিযোগে চম্পাবুকে প্রকাশ্যে কারা পিটুনি দিল সবাই দেখেছে। আমার প্রশ্ন-দিনেদুপুরে এভাবে কেউ একটা নারীকে লাঠি দিয়ে মারতে পারে ? মানুষ কখন মানুষ হবে ?
ইদানিং দেখা যাচ্ছে-গুজব কানে নিয়ে মানুষ লাঠি হাতে তুলে নিচ্ছেন । পুলিশ বলছে-গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা এবং গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা ফৌজদারি অপরাধ। তারপরও আমরা ছেলেধরা গুজব এবং গণপিটুনিতে জড়িয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছি। কিন্তু এটা কতদিন চলতে থাকবে ?
‘পদ্মা সেতু’র নির্মান কাজে মানুষের মাথা লাগবে-এমন গুজব ছড়ানো হলো। শিশুর মাথা হলে নাকি বেশি ভালো হয়। এরপর কে কাকে থামায়। হুজুগে বাঙ্গালি ছুটছেন গুজব নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লকসহ অখ্যাত কিছু গণমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে সহজসরল মানুষজনকে বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত করছে। গুজবের সঙ্গে যুক্ত হলো আতঙ্ক।
২০ জুলাই মহেশখালীর কালারমারছড়ার চালিয়াতলীতে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি খেয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক রোহিঙ্গা নারী। উখিয়ার কুতুপালং শিবির থেকে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মহেশখালীতে পৌছে গণপিটুনির শিকার। এর আগে বান্দরবানেও এক রোহিঙ্গা কিশোরীও গণপিটুনির শিকার হয়েছে। তারও আগে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ও রাজধানীতে ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ফেনীতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে একই অভিযোগে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে চলছে গণপিটুনির মহোৎসব। দেশের কিছু মানুষ ক্রমান্বয়ে পশুর আচরণ করছে। এর হেতু কি ?
অনেকে বলেন, নেত্রকোনায় ব্যাগ থেকে শিশুর মাথা উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরেক যুবক। তাহলে এটাও কি গুজব ?
কিন্তু পুলিশ বলছে- এ ঘটনার সঙ্গে ছেলেধরা কিংবা পদ্মা সেতুতে বলির গুজবের কোনো সম্পর্ক নাই। এটা হত্যাকান্ড।
কিন্তু কুচক্রি মহল বসে নেই। তারা ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্রমে এই শিশুর মাথা ছড়িয়ে দিয়েছে গুজবকে সত্য বলে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে গেছে গণপিটুনি। গত কয়েক দিনে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে অন্তত ১০ জন।
গুজবের বিরুদ্ধে তখন থেকে মানুষজনকে সচেতন করার মতো উল্লেখযোগ্য প্রচারণা-সামাজিক আন্দোলন চোখে পড়েনি। ততোদিনে গুজবের ডালপালাও গড়িয়েছে অনেক দুর। এখন আর না। মানুষের হাতে আইন তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। গুজব এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকার, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীকে। সোচ্চার হতে হবে শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক সমাজ, সামাজিক-সংস্কৃতিক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের।
পুলিশ বলছে- ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে হত্যার মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টির পায়তারা চালাচ্ছে অশুভ শক্তি।
গুজবের ভিত্তিতে কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জারি করেছে সরকার। ছেলেধরা সন্দেহে সাম্প্রতিক হতাহত হওয়ার কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে গত ২২ জুলাই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ মানুষ পিটিয়ে হতাহত করছে। ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী এবং গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। কোনো বিষয়ে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে নিজের হাতে আইন তুলে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে থানাসহ সব পুলিশ অফিসে অভ্যন্তরীণ সার্কুলার জারি করেছে। সব পুলিশ ইউনিটকে টহল জোরদার এবং সব বিদ্যালয়ের সামনে প্রহরা জোরদার ও স্কুলশিক্ষক, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অভিভাবকদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে স্কুল ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
মানুষের মন থেকে গুজব দুর করতে হলে কিছু কর্মসুচি হাতে নিতে হবে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে। প্রথমত স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষকদের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের গুজব সন্দেহ দুর করতে হবে। প্রতিটি স্কুলের ক্যাম্পাসের সামনে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। স্থানীয় দৈনিক, অনলাইন গণমাধ্যম ও ডিস-ক্যাবলে ছেলেধরা গুজব সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। গ্রাম এলাকায় ছেলেধরার বিরুদ্ধে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ, শুক্রবার জুমার নামাজে মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে খুতবা এবং যেকোনো ধরণের সভা-সমাবেশে গুজববিরোধী আলোচনা করতে হবে।
পাশাপাশি ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কারা গুজব ছড়াচ্ছে-তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। বাড়াতে হবে নজরদারি। নইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত শহর কক্সবাজার। কক্সবাজারে মানবিক আশ্রয়ে রয়েছে মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত চলছে বহু আগেই। এরমধ্যে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়দের গন্ডগোল বাঁধানোর চক্রান্ত যে হচ্ছে না, সে কথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে না গেলে আমাদেরই বেশি ভোগতে হবে ।
গুজব নিয়ে আমরা আর নির্মমতা দেখতে চাইনা। ফেসবুক কিংবা অন্যকোনো গণমাধ্যমে দেখতে চাইনা গণপিটুনিতে নিহত কোনো মায়ের সন্তানের মুখ। হারাতে চাইনা কোনো মা বাবা ভাই বোনকে। আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেবো না।
আসুন-গুজব নিয়ে মানুষের মনে যে সন্দেহ, তা দুর করার কাজে ঝাপিয়ে পড়ি। সন্দেহের জায়গাটা আমরা আস্থায় ভরিয়ে দেই। নিজের নিরাপত্তা নিজে নিশ্চিত করি। কারণ সমাজিক অস্থিরতা দুর করতে আস্থার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
# লেখক : দেশের শীর্ষ দৈনিক ‘প্রথম আলো’র স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক-কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন।
Posted ২:২৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta