কক্সবংলা ডটকম(৫ ফেব্রুয়ারি) :: গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমার। জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে মিয়ানমার পরিস্থিতি। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে সীমান্তবর্তী প্রদেশে সামরিক সরকারের তুমুল লড়াই চলছে। বিদ্রোহীদের ক্রমাগত হামলার মুখে দেশের প্রায় অর্ধেক হাতছাড়া হয়ে গেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের। ফলে দিশাহারা দেশটির সরকার। একই সঙ্গে নেতৃত্ব নিয়ে হতাশ সমর্থকরাও। এর ফলে অনেকটা পতনের মুখে রয়েছে জান্তা সরকার। একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে সব এলাকায়। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে সাধারণ নাগরিকরা। এমনকি সশস্ত্র বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শত শত সদস্য হয় বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে; না হয় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশি দেশে।
এদিকে চীন-ভারতের মতো অভিন্ন মিত্রের সহায়তাই এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সমাধানের শান্তিপূর্ণ পথ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। শুধু চীন বা ভারত নয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের অভিন্ন বাকি মিত্রদের এ সংকট সমাধানে কাজে লাগানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী- অগ্নিগর্ভ পুরো মিয়ানমার। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তেও। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সামরিক জান্তার সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সংগঠন আরকান আর্মির তুমুল লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
রবিবার সকাল থেকে লাগাতার গোলাগুলি ও মার্টারশেল নিক্ষেপ হয়েছে। বিকালে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছোড়া গুলিতে আরো এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। এর আগে সকালে ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে দুই বাংলাদেশি আহত হন। তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গুলিতে আহতদের একজন পবীন্দ্র ধর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ধরে চলা গোলাগুলিতে কম্পিত হয় পুরো সীমান্ত এলাকা।
গোলাগুলির ভয়াবহতা দেখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ৫৮ সদস্য। তাদের বিজিবি ক্যাম্পে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত জনকে নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশ কারো সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না। তবে কেউ গায়ের ওপর এসে পড়লে ছেড়ে দেয়া হবে না। আমরা সবসময় তৈরি আছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে সবসময়ই নানা ধরনের বিদ্রোহ লেগেই আছে। স¤প্রতি আমরা দেখেছি, রাখাইনের অনেক এলাকা একের পর এক দখল করে নিচ্ছে আরাকান আর্মি নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ক্রমাগত তারা শক্তিশালী হয়ে আরো সামনের দিকে এগোচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে।
মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ঘাঁটিগুলো একের পর এক দখল করে নিচ্ছে আরাকান আর্মি। আমাদের সীমান্তসংলগ্ন যেগুলো ছিল; সেগুলো তারা দখল করে নিয়েছে। আত্মরক্ষার্থে বিজিপির কয়েকজন সদস্য আমাদের সীমানায় ঢুকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। বিজিবি সদস্যরা তাদের অবরুদ্ধ করেছে। তাদের অস্ত্র জমা নিয়ে একটি জায়গায় আটকে রেখেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, যাতে তারা এদের নিয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদের আর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান কামাল তিনি বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত একটিই- সীমান্তে এখন যুদ্ধ চলছে; এখানে কারো আসা উচিত হবে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যদি মনে করে, তাদের ওখানে যুদ্ধ হচ্ছে, তারা অন্য কোথাও যাবে, এ মুহূর্তে আর কাউকে আমরা ঢুকতে দেব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকারের প্রশ্ন এখন আসবে না, কারণ যুদ্ধ চলছে। গোলাগুলি চলছে। এখানে কারো আসা উচিত হবে না। যেই আসবে, তাকে আবদ্ধ করে মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেব।
এদিকে মিয়ানমারের এমন পরিস্থিতিতে ক্রমেই সমর্থন হারাচ্ছেন সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এই সংঘাতের আঁচ মিয়ানমারের সীমান্ত ছাপিয়ে বাংলাদেশেও লাগছে। বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে তীব্র সংঘাত চলছে মিয়ানমার সৈন্যদের।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। এখন থেকে তিন বছর আগে মিয়ানমারে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে হটিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক সরকার।
এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জান্তাবিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। একইসঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন তাদের শক্তি আরো বাড়িয়ে তোলে। এসব গ্রুপও জান্তা সরকারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে। তিন বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির শান ও রাখাইন প্রদেশে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা এ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টম কিন বিবিসিকে বলেন, ‘এই সংঘাত একটি ভিন্নমাত্রার ও জটিল বিষয়। এখানে নানা ধরনের পক্ষ জড়িত আছে।’
পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই সংঘাত কীভাবে শেষ হবে তার কোনো সুস্পষ্ট নিশানা দেখা যাচ্ছে না। গত তিন বছরে এসব গোষ্ঠী মিয়ানমারে ৩০০ বেশি সামরিক চৌকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার কি ভেঙে পড়ার হুমকিতে আছে? প্রভাবশালী দেশ চীন এখানে কী ভূমিকা রাখছে?
সূত্র মতে,মিয়ানমারের ওপর একটা সময় চীনের বেশ প্রভাব ছিল। কিন্তু সে প্রভাব এখন অনেকটাই খর্ব হয়েছে। তারপরেও মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেব চীন রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে চীনের মধ্যস্থতায় তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও সেটি কোনো ফল দেয়নি। এরপরেও বিভিন্ন স্থানে সংঘাত অব্যাহত আছে। তবে এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি শুধু চীন সীমান্তসংলগ্ন শান প্রদেশের জন্য।
এই প্রদেশটিতে ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সংঘাত চলমান আছে। এই প্রদেশে বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও শান প্রদেশে বিক্ষিপ্ত সংঘাত চলছে। তবে দেশের অন্য জায়গায় এই যুদ্ধবিরতি কোনো কাজে লাগেনি।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, চীন এখানে মধ্যস্থতা করেছে তার নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য। এখানে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গৌণ বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক থারাফি থান এশিয়ান টাইমসে এক নিবন্ধে লিখেছেন, মিয়ানমারের অস্থিরতা যাতে সীমান্ত ছাপিয়ে চীনের ভেতরে না যায় সেজন্য তারা বেশ উদ্বিগ্ন।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনের সীমান্তে তাদের অধিবাসীদের ক্ষতি না করা এবং মিয়ানমারের ভেতরে চীনের প্রকল্পে যারা কাজ করছে তাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে নিশ্চয়তা দিয়েছে উভয়পক্ষ।
এখানে উভয় পক্ষ বলতে সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং মিয়ানমারের সৈন্যদের বোঝানো হয়েছে। এজন্যই চীন মিয়ানমারে অস্থিরতা শান্ত করার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর চীন ‘খুশি নয়’ বলে উল্লেখ করেন ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টম কিন। কারণ, চীনের বিভিন্ন অপরাধীচক্র শান প্রদেশে কিংবা মিয়ানমারের ভেতরে বসে নানা ধরনের সাইবার অপরাধ, মাদক, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি চীনের জন্য সমস্যা তৈরি করলেও মিয়ানমার জান্তা সেটি দমনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
টম কিন বলছিলেন, ‘চীনের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শান প্রদেশে অস্ত্রবিরতির জন্য চীন চেষ্টা করলেও রাখাইনে অস্ত্র বিরতি নিয়ে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। আরাকান আর্মি যতদিন পর্যন্ত রাখাইনে চীনের স্বার্থের ওপর আঘাত করবে না ততদিন পর্যন্ত চীন কিছু বলবে বলে মনে হয় না’।
মিয়ানমারের যুদ্ধবিরতি চীনের চাওয়ার ওপর এখন আর খুব বেশি নির্ভর করে না। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে মিয়ানমারে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক থাকে। এর আগে অং সান সুচির সরকারের সঙ্গেও তাদের ভালো সম্পর্ক ছিল।‘আমার মনে হয় চলমান সংঘাতে চীন কোনো পক্ষ নেবে না। তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও মদত দেবে না, মিয়ানমার সামরিক সরকারকেও সাহায্য করবে না,’ বলেন টম কিন।
ব্যাংককভিত্তিক বিশ্লেষক ডেভিড স্কট ম্যাথিসন বলেন, ‘মিয়ানমারে সংঘাতের সময় চীন চাইবে তার স্বার্থ রক্ষা করতে। চীন তার নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি জড়িত।’
তাছাড়া মিয়ানমারজুড়ে সব পক্ষকে একসঙ্গে করে একটি যুদ্ধবিরতি করানোর সামর্থ্যও চীনের নেই বলে মনে করেন ম্যাথিসন। মিয়ানমারে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন হলে সেটি চীন কীভাবে দেখবে সেটিও একটি বড় বিষয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নেবে চীন। তবে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট বা এনইউজি, যারা দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত, তাদের ব্যাপারে চীনের আপত্তি রয়েছে বলে মনে করেন টম কিন।
কারণ, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দেয়। যদিও এনইউজি এই ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে এবং তারা চীন নিয়ে একটি নীতিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারপরেও তারা যে পশ্চিমাসমর্থিত নয় এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন বলে মনে করেন টম কিন। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে যদি স্থিতিশীলতা না আসে তাহলে সেটি চীনের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে থাকবে।
হুমকির মুখে সামরিক জান্তা?
ব্যাংককভিত্তিক বিশ্লেষক ডেভিড স্কট ম্যাথিসন বলেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার হুমকির মুখে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মুখে তারা সহসা ভেঙে পড়বে কিনা, সেটি এখন বলা কঠিন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, সংঘাত যেভাবে চলছে এবং সেনাবাহিনীর যে শক্তি আছে তাতে মনে হচ্ছে এটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে এবং দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনীর পরাজয় হতেও পারে। তবে, সেটা কতদিন লাগবে কিংবা সেটা কীভাবে হবে তা বলা কঠিন।
মিয়ানমারে এখন যে পরিস্থিতি সেটিকে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টম কিন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে মিয়ানমার জান্তা সরকার ভেঙে পড়ার হুমকিতে আছে। এই সংঘাত মূলত রাখাইনে ও শান প্রদেশে সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। দেশের ভেতরের দিকে এখনো ছড়ায়নি।
এটা নিশ্চিতভাবে রোহিঙ্গাপ্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরো জটিল করবে। আরাকান আর্মি রাখাইনে একটি রাজনৈতিক শক্তি। রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় বসবাস করত এবং এখনো যেসব এলাকায় তারা বসবাস করে সেখানে আরাকান আর্মি তাদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
একটা যুদ্ধবিরতি হলেও সেটি টেকসই হবে না বলে মনে করেন টম কিন। সংঘাত যে কোনো সময় শুরু হবে। আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা না করে সেখানে রোহিঙ্গাদের কীভাবে ফেরত পাঠানো যাবে- এমন প্রশ্ন তোলেন টম কিন। যদিও রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আমির্র দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। তারা রোহিঙ্গাদের শত্রæ মনে করে না। তিনি মনে করেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিকে সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে বাংলাদেশকে।
মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশ করা সেখানকার সংকটময় পরিস্থিতির একটি ইঙ্গিত বলে জানিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, প্রথমত, আহত বাংলাদেশিদের সহায়তা করতে হবে। তাদের সুচিকিৎসা ও আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এখানে আসবে।
দ্বিতীয়ত, সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। কারণ এতদিন সেখানকার সংঘাতে বাংলাদেশ কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি। তবে এখন যেহেতু তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকেছে, ফলে প্রচেষ্টা থাকতে হবে– এ সংঘাত যাতে কোনোভাবেই সীমান্তের এপারে চলে না আসে। সেই সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব সদস্যকে ফেরতের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে কী হচ্ছে তার একটি সম্মুখ ধারণা বাংলাদেশের থাকা উচিত। সেখানকার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা জানতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চীন, ভারত, আশিয়ান বা থাইল্যান্ডের মতো দুই দেশের অভিন্ন বন্ধুদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে মিয়ানমার নিয়ে অভিন্ন মিত্রদের মূল্যায়ন কী, তারও ধারণা বাংলাদেশের প্রয়োজন। এ ছাড়া কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা, তাও ভেবে দেখতে পারে ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য ঢুকেছেন, তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। কারণ এখানে দেশটির সামরিক বাহিনীর ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের এখন বড় আকারের আন্তর্জাতিকীকরণ করা প্রয়োজন। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকলে এখানে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। সেই সঙ্গে সংকট সমাধানে দিল্লির সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে চীনসহ অন্য যেসব অভিন্ন মিত্র রয়েছে তাদের সহায়তাও বাংলাদেশের প্রয়োজন।
গত অক্টোবরে আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনীবিরোধী সশস্ত্র জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আরাকান আর্মি ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চাপে থাকা সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণ শুরু করে। গত ১১ সপ্তাহে চীনের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অংশে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আক্রমণে পিছু হটে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সর্বশেষ গত শনিবার মিয়ানমারের ভারতঘেঁষা পালেতোয়া শহরের মিওয়া ঘাঁটির শেষ সেনা চৌকিটি দখলে নেয় আরাকান আর্মি। ২০২০ সালে এ ঘাঁটিই ৪২ দিনের টানা লড়াইয়ের পর দখল করতে ব্যর্থ হয় বিদ্রোহীরা। ইতোমধ্যে এসব এলাকা থেকে কয়েকশ মিয়ানমারের সৈনিক পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা এটাই প্রথম।
Posted ১:৩০ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta