বিশ্বজিত সেন(২২ মার্চ ) :: কোন এক অদৃশ্য সুতোর টানে জীবনের আদর্শ কর্তব্যবোধ মানুষকে অসম সাহসী করে তুলে। দেশ- মানুষ- প্রকৃতি আর নতুন স্বপ্নের পেছনে মানুষের প্রতিদিনের অভিযাত্রা। এই ছুটে চলার পথ পরিক্রমায় কেউ হয়তো ফিরে হয়তো কেউ মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু রেখে যায় জীবনের মহাস্থিতি। যেখানে পরবর্তীতে উদ্বেলিত হয় মানুষ-সমাজ-সভ্যতা। ঐ মিলিয়ে যাওয়া মানুষটা হয়ে যায় চিরঞ্জীব চির উজ্জ্বল, যাকে ঘিরে মানুষ স্বপ্ন দেখে নতুন এক অভিযাত্রার!
একই সাথে কোন না কোন বিষয় মানুষকে জাগিয়ে দেয়, সে ধরনের কোন কাজ বা অবদান- যে কোন জনগোষ্ঠীর জন্য মহৎ অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে জাতি-রাষ্ট্রের অনেক প্রাণময় ইতিহাসের সুবর্ণ গাঁথা আছে। যার প্রতিটি সিঁড়িতে মানুষের শ্রম, মেধা, সাহস, ত্যাগ বিশেষভাবে জড়িত। এসবকে নিয়ে ইতিহাস রচিত হয়। মানুষ এগিয়ে যায় অদম্য সাহসে গৌরবের আলোকবর্তিকা নিয়ে সময়ের হাত ধরে।
সে রকম একটি দিন এসেছিলো দেশের প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে। বাংলাদেশের দক্ষিণের প্রান্তিক এলাকার শ্রম মানুষ রফিকুল আলম নিসর্গ রক্ষার প্রত্যয়ে দাঁড়িয়েছিল সাহসী মানুষ হয়ে। বাংলাদেশ বন বিভাগের নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে শুনতে পেয়েছিলো প্রকৃতি রক্ষার বাণী- আর সবুজের রক্তক্ষরণ নয়, এসো আমরা সবুজকে রক্ষা করি। প্রকৃতি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আটাশ বছরের টগবগে যুবক বনবিভাগ এবং নিসর্গ কর্মীদের সচেতনতা কর্মসূচীতে বিভিন্œ সময়ে অংশগ্রহণ করে ধীরে ধীরে সে নিজের মধ্যে সবুজ বৃক্ষের সূচনা করে।
২০০৮ সালের ২৩ মার্চ ভোরবেলা দুস্কৃতিকারীদের ছুরিকাঘাতে যখন তার প্রাণবায়ু বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখনও রফিকুল আলম সবুজ কাঠকে জড়িয়ে ধরেছিলো আপন করে। কিন্তু অত্যাধিক রক্তক্ষরণে রফিকুল আলমের জীবন দীপ এক সময় নির্বাপিত হয়ে যায়। পিছনে পড়ে থাকে সবুজের আস্তরণে রফিকের টকটকে লাল রক্ত আর শোকার্ত পরিবার পরিজনদের আহাজারি। এ যেন পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার এক কান্না…।
২০০৮ সালের ২৩ মার্চ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের সামনে রফিকুল আলমের নিথর মরদেহ! তাঁকে ঘিরে কাঁদছে কয়েকজন নারী-পুরুষ। কেউ কেউ বেদনাহত মন নিয়ে লাশটিকে ঘিরে আছে। নিজেই যখন বিমর্ষ মনে অশ্রুসজল চোখে রফিকুলের কপোলে-চুলে হাত রাখলাম। তখন মনে আসলো এতো রফিকুল নয়, সেতো আমাদের ভাই। যাকে একসময় আমরা টেনে এনেছিলাম সবুজ রক্ষার আন্দোলনে।
চোখে তার অনেক স্বপ্ন ছিল, জীবন পরিবারকে গুছিয়ে নেবার জন্য। তবে কর্তব্যের টানে সেটা আর হয়ে উঠেনি। অসময়ে জীবন বিলিয়ে দিলো সবুজ রক্ষা আর অনেক জীবনের তরে। সেসময় নিজের ভিতরে একটি বারবার প্রশ্ন ছিলো বন সবুজ প্রকৃতি রক্ষার জন্য জীবন দেওয়া রফিকুল আলম কি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে অসংখ্য মৃত্যুর মতো! সেই প্রশ্নের উত্তর তখন পাইনি।
২০১৮ সালের (মৃত্যুর দশ বছর পর) এসে দেখি রফিকুল আলমের রক্তে রঞ্জিত ২৩ মার্চ এখন দেশে-বিদেশে সহব্যবস্থাপনা দিবস হিসেবে পালিত হয়। রফিকুল আলমকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন সেখানেই রফিকুলরা চিরঞ্জীব সত্তা হয়ে আলো ছড়ায়, এখানেই প্রকৃত বীরের অনন্য কীর্তি। গরিব ঘরের মানুষ প্রকৃতি রক্ষার নিসর্গ শহীদ হযে সবুজ পাতার ধ্বনির মধ্যে চিরদিন বেঁচে থাকে। এখানেই একজন কীর্তিমান মানুষের সাথে অন্যকিছুর তফাৎ!
রফিকুল আলমের জন্ম ১৯৭৯ সালে ২৫ জানুয়ারী, কক্সবাজার জেলার, টেকনাফ উপজেলার, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর গ্রামে। পিতা- নুর মোহাম্মদ, মাতা (বর্তমানে মৃত) লায়লা বেগমের ঘরে ৫ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল পরিবারের প্রথম সন্তান। বাবা মার আদরের বড় সন্তান রফিকুল আলম অভাব অনাহারে দারিদ্রে বেড়ে উঠেছিলো। মক্তবের লেখাপড়া শেষ করে স্থানীয় শামলাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে। এরপর পরিবারের আর্থিক অসংগতির কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। প্রথমে কৃষি শ্রমিক, পরবর্তীতে মৎস্য শ্রমিক হয়ে পিতার অভাবের সংসারে সাহায্য করতো। ছোটকাল থেকেই মানুষের প্রতি দরদবোধ নিয়ে সে কাজ করে যেতো। শামলাপুরের পুরান পাড়ায় বসবাসরত রফিক বড় হয়ে উঠে এলাকার একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী হিসেবে।
কঠোর পরিশ্রম করে সে এক সময় মৎস্য শ্রমিক থেকে ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। ২০০১ সালে জাহেদা বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় রফিক। কয়েক বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় দু’কন্যা সন্তান, মিতা নূর এবং উম্মে আক্তার। রফিকুল সারাদিন পরিশ্রম করে যখন বাড়ী ফিরতো, তখন দু’অবোধ কন্যা ঝাপিয়ে পড়তো বাবার বুকে। বাবার বুকে দু’বোন মুখ লাগিয়ে বসে থাকতো অনেকক্ষণ ধরে। সময় গড়িয়ে গেলেও এখনো অসময়ে পিতৃহারা কন্যাদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে, হায় কে করবে প্রিয় কন্যাদের স্নেহ এবং আদর। পিতার অসম্পূর্ণ স্নেহের কাঙাল হয়ে তারা কাটাবে সারা জীবন চাপা দুঃখবোধ নিয়ে।
২০০৫ সালে টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য রক্ষার উদ্দেশ্যে বন বিভাগের নিসর্গ কর্মসূচীর আওতায় টেকনাফ, শীলখালীতে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তখন রফিকুল ঘরের টানাপোড়ন আর ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। পরবর্তীতে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের একটি জনসচেতনতা সভায় যোগ দেওয়ার পর তার মধ্যে নতুন অনুরণন আসে।
প্রকৃতি রক্ষার চেতনায় সে প্রায় সময় নিসর্গের বিভিন্ন সভা সমাবেশে যেতো। ২০০৬ সালের দিকে নিসর্গ বন পাহারাদল গঠিত হলে ১৫ অক্টোবর সে বন পাহারা দলে যোগদান করে। এর পূর্বে অবশ্য ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে বন ও পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠি এবং বন বিভাগের অংশগ্রহণের গঠিত হয় শিলখালী সহ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল এবং কমিটি।
রফিকুল বন পাহারা দলে যোগদান করে ভাল কাজকর্মের জন্য শীলখালী আকাশমণি বন পাহারা দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ৪২ জনের নিসর্গ পাহারা দলটি শামলাপুর সেগুন বন, মনতালিয়া বিটের বিভিন্ন এলাকায় দিনে এবং রাতে বন বিভাগের সদস্যদেও সাথে বন পাহারা দিতো। রফিকুল আলমদের তৎপরতায় শামলাপুরে বৃক্ষ নির্ধন এবং চুরি ক্রমান্বয়ে কমে যায়, তখন কাঠ পাচারকারী, অপরাধী সন্ত্রাসীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয় রফিকুল। কাঠ পাচারকারীরা রফিকুলকে হত্যার পূর্ব থেকেই প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিলো। টগবগে যুবক রফিকুল সেগুলোর কোনদিন কর্ণপাত করেনি। বরঞ্চ আরো বিপুল উদ্যমে সে কাঠচোরদের প্রতিহত করেছে।
২৩ মার্চ ২০০৮ রাতে রফিকুল খবর পায়, মনতলিয়া এবং সেগুন বাগান এলাকায় কাঠ চোরেরা গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রফিকুল নিজের পিতা স্ত্রী সহ পরিবার পরিজনদের বাধা না মেনে কাঠচোরদের প্রতিহত করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। পথিমধ্যে রফিকুল কাঠচোরদের গাছ নিয়ে যাওয়ার সময় বাধার সৃষ্টি করলে সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। মারাত্মক আহত অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রফিকুল আলম ঘটনাস্থলের অদূরেই মৃত্যুবরণ করে। এরপর মানুষ থেমে থাকেনি। রফিকুলের আত্মত্যাগের মহিমায় মানুষ চলেছে সামনের কাতারে
রফিকুলকে হত্যা করে প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি। রফিকুলের রক্ত, কবর ছুঁয়ে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থীরা প্রতিজ্ঞা করেছিল প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক বাধা-বিঘœ পেরিয়ে প্রকৃতি রক্ষা এবং সহব্যবস্থাপনা আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই উদাহরণ শুধুমাত্র দেশে নয়, বিদেশেও প্রকৃতি কর্মীদের কাছে আদর্শ হিসেবে সম্মানিত হচ্ছে। এখানেই রফিকুলের আত্মত্যাগের অনন্য সার্থকতা।
দশ বছর হয়ে গেলেও রফিকুলের হত্যার বিচার চূড়ান্ত হয়নি। পিতা- নুর মোহাম্মদ বাদী হয়ে টেকনাফ থানা নং- ২২, ২৩ মার্চ ২০০৮ এ মামলা করেছিল। প্রথমে ঘটনাস্থল থেকেই পাঁচজন আসামী গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁকফোকরে ৪ জন জামিন পেয়েছে। এই নিবেদিতপ্রাণ প্রকৃতি কর্মীর হত্যার বিচার মানুষ আশা করে। চূড়ান্ত বিচার হওয়াটা বিশেষভাবে কাম্য।
রফিকুল আলমের মৃত্যুর পর তাদের পরিবারে অভাব আরো প্রকটভাবে নেমে আসে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়াতে তার পিতা নূর আহমদ, স্ত্রী- জাহেদা বেগম এখনো দুটি কন্যা নিয়ে অসহায়ভাবে দিনযাপন করছেন। নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পসহ সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় এক লক্ষ টাকার মতো সাহায্য সহায়তা তারা পেয়েছে।
পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় রফিকুলের এই আতœদানকে সম্মান জানিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১ জুন জাতীয় বৃক্ষমেলার উদ্বোধনে অনুষ্ঠানে রফিকুলের পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করেছেন। এর বাইরেও তাদের জন্য নিত্যদিনের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
রফিকুলের আত্মত্যাগের এই মহতী দিনকে স্মরণ করে প্রতি বছর ২৩ মার্চ ‘সহ-ব্যবস্থাপনা দিবস’ হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশের প্রকৃতি রক্ষা এবং সহ-ব্যবস্থাপনা সংগঠনগুলো শ্রদ্ধাভরে পালন করে। এইদিনের চেতনায় প্রান্তিক বননির্ভর সহ সকল পর্যায়ে মানুষ পরিবেশ রক্ষার শপথ গ্রহণ করে। সারা বাংলাদেশ থেকে উচ্চারিত হয় এই প্রকৃতি আমার, এই সবুজ আমার, সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন রক্ষার আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এক জীবন থেকে অন্য জীবনে।
নিসর্গ শহীদ রফিকুল আলম, সবুজকে ভালোবেসে জীবন দিয়ে উত্তর প্রজন্মের জন্য বিশাল ঋণ রেখে গেছে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সে নিসর্গ বন পাহারা দলে কাজ করতো। এই সময়ে সমাজে যখন পাওয়াটাই মুখ্য, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ রফিকুলের জীবন দান এক অনন্য ঘটনা। সবুজপত্রের মর্মরে ভোরের শিহরণ জাগে। সবুজের পল্লবিত ছোঁয়ায় রফিকুল বেঁচে থাকবে অনন্ত জীবন ধরে বৃক্ষ, ফুল, নদী, পাহাড় আর অসংখ্য প্রাণের মাঝে। শ্রদ্ধা ভালোবাসা-নিসর্গ শহীদ আমাদের প্রিয় ভাই রফিকুল।
————————–
লেখক : বিশ্বজিত সেন- গবেষক, সাংবাদিক, পরিবেশবিদ
ই-মেইল : senbishawjit@yahoo.com; bishawjitsen@gmail.com
Posted ৭:৩২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta