কক্সবংলা ডটকম(৭ ফেব্রুয়ারি) :: দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্যের বা নগদ টাকার চাপ আবার বেড়েছে। এই চাপ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের প্রবণতাও বেড়েছে। পাশাপাশি কলমানি মার্কেট থেকেও ধার করছে ব্যাংকগুলো। এছাড়াও এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে মেয়াদি আমানতও নিচ্ছে। তারল্য সংকট মোকাবিলায় বাড়তি আমানত সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যে অনেক ব্যাংক আমানতের সুদ হার বাড়িয়েছে। কিছু ব্যাংকে এ হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
অপরদিকে প্রায় দুই বছর ধরে দেশে চলছে ডলার সংকট। এ সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার নেপথ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। ডলার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ডলার আয়-ব্যয়ের প্রধান খাত রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ঘাটতি প্রলম্বিত হয়েছে। এতে সংকট বেড়েছে।
এ সংকটের টেকসই সমাধানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় আনা হবে। এর অংশ হিসাবে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ভারমাস্য আনার পদক্ষেপ থাকবে। এজন্য আমদানিনির্ভর অর্থনীতির আকার কিছুটা হলেও ছোট করা হবে। ফলে আমদানি ব্যয় কমানো ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের চাপ কমিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৭০ শতাংশই আসে রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আসে ২৮ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ আসে বৈদেশিক বিনিয়োগ, ঋণ ও অন্যান্য খাতে। ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে আমদানি। এর বাইরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও দেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা পাঠানো।
গত কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। এতে ডলারের চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উঠেছিল। এর পর থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় এখন ঘাটতি কমে আসছে। গত অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি ডলারে। চলতি অর্থবছরের জুলাই ডিসেম্বরে ওই ঘাটতি মিটিয়ে ৫৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে ডলারের সার্বিক হিসাবে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। চলতি হিসাবের ঘাটতি মিটিয়ে উদ্বৃত্ত হলে পর্যায়ক্রমে সার্বিক হিসাবেও ঘাটতি কমে যাবে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে রপ্তানি আয় ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে আমদানি। এ দুটির মধ্যে ভারসাম্য নেই। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি ৩০ শতাংশ। আগে আরও বেশি ছিল। রপ্তানির চেয়ে আমদানি ৪৫ শতাংশ বেশি ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে আমদানি কমিয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে। ওই সময়ে বাজারে ডলারের প্রবাহ বেশি থাকায় আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমদানি বেড়েছে। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে দেশে।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট শুরু হওয়ায় আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। এতে আমদানিনির্ভর ব্যবসার প্রসার কমতে থাকে। আমদানিতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে এ খাতের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। যা এখনো চলমান। ডলার সংকটের টেকসই বা স্থায়ী সমাধানের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ও ব্যয়ে মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যয়ের খাত কমানো হচ্ছে। আয়ের খাত বাড়ানো হচ্ছে। ব্যয়ের খাতের মধ্যে প্রধান হচ্ছে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ। আয়ের খাতের মধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একই বছরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় কমেছিল বেশি, ব্যয় কমেছে তুলনামূলক কম। ফলে ডলারের ঘাটতি বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল তিন হাজার ৮৭৬ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। একই বছরে আমদানি হয়েছিল পাঁচ হাজার ৭২৬ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। ওই বছরে আয় বাড়ার তুলনায় ব্যয় বাড়ার হার কমলেও সার্বিকভাবে ঘাটতি ছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল পাঁচ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। আগের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হয় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। একই বছরে আমদানি হয় আট হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। আগের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। এ বছরে আবার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বেড়ে যায়। ফলে ঘাটতিও বাড়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয় পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার। আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। ওই বছরে আমদানি হয় সাত হাজার ২৮৬ কোটি ডলার। আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে ব্যয় কমেছে, আয় কিছুটা বেড়েছে।
গত অর্থবছরের জুলাই ডিসেম্বরে রপ্তানি হয় দুই হাজার ৭৩১ কোটি ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। ওই বছরের একই সময়ে আমদানি হয় চার হাজার ১১৮ কোটি ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে দুই হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে আমদানি হয়েছে তিন হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। এভাবে আমদানি রপ্তানিতে ভারসাম্য আনা হচ্ছে।
একইভাবে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পরিশোধ। ফলে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমে এসেছে। এর স্থিতি এক বছরের ব্যবধানে ৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে কমে ৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে নেমেছে। এক বছরে ঋণ কমেছে ৪০০ কোটি ডলার।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হুন্ডি কমাতে ব্যাংকিং সেবার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। যেসব দেশে হুন্ডি বেশি হচ্ছে ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হুন্ডির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে পৌনে ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
এদিকে দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট মোকাবিলায় চলতি মাসের মঙ্গলবার পর্যন্ত চার কার্যদিবসে ব্যাংকগুলো বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করেছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে কলমানি মার্কেট ও স্বল্প ও মেয়াদি ধার হিসাবে প্রতিদিনই আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ধার করছে। কলমানিতে ধার করা ব্যাংকগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে বিশেষ প্রয়োজনে।
সরকারকে ঋণের জোগান দিতে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনে তা জরুরি প্রয়োজনে ফের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে নগদ টাকা ধার নিতে পারে। এ উপকরণ ব্যবহার করেই এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার করছে।
গত বৃহস্পতিবার ১ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একদিন মেয়াদি রেপোর (ট্রেজারি বিল পুনরায় কিনে নেওয়ার চুক্তি) আওতায় ধার করেছিল ১২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। রোববার ৪ ফেব্রুয়ারি ধার করেছে ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, গত সোমবার ধার করেছে ২১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। যা গত দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিন কলমানি মার্কেট থেকে নিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। দুটো মিলে ওইদিন ধারের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। মঙ্গলবার রেপোর মাধ্যমে নিয়েছে ১৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কলমানি মার্কেটসহ এদিন মোট ধার করেছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে গত সোমবার ও মঙ্গলবার এ দুই দিনে ধার করেছে প্রায় সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
মঙ্গলবার ব্যাংকগুলো কলমানি মার্কেট, স্বল্প ও মেয়াদি ধার করেছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। সুদের হার সাড়ে ৯ শতাংশেই রয়েছে। এ হার এর মধ্যে কয়েকদিন ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মেয়াদি ধারের সুদ হার পৌনে ১২ শতাংশে উঠেছে। আগে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এ সরকার নতুন করে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ বিতরণের চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে আমদানির চাপও বেশি। আসন্ন রোজা উপলক্ষ্যে উদ্যোক্তারা ডলার কিনে এলসি খুলছেন। এতে করে টাকার চাহিদা বেড়েছে। এদিকে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমেছে রেকর্ড পরিমাণে। তারপরও ব্যাংকে তারল্য সংকট কাটছে না।
এটিকে অনেক ব্যাংকার অস্বাভাবিক মনে করেন। কারণ সরকারই সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ঋণ ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যা আগে ছিল হাজার কোটি টাকার ওপরে। এ হিসাবে ব্যাংকে তারল্য সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে অনেকে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং আগের ঋণ পরিশোধ করায় বাজারে তারল্যের প্রবাহ কমেছে। এ কারণে সংকট দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের চাপ আরও বাড়বে। সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোতে যে হারে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, ওই হারে আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের কিছুটা টানাটানি রয়েছে। এছাড়া আমদানি দায় মেটানো, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও রোজা উপলক্ষ্যে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য নতুন এলসি খুলতে ডলার কেনার ক্ষেত্রে টাকার চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। এ কারণে অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ আমানত রাখতে পারছে না। কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাব নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। ওইসব ঘাটতিও মেটাতে হচ্ছে।
Posted ১:০১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta