সোমবার ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

সোমবার ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী হতদরিদ্রদের নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ২৫০ কোটি টাকা লোপাট

শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
56 ভিউ
কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী হতদরিদ্রদের নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ২৫০ কোটি টাকা লোপাট

আব্দুল কুদ্দুস রানা,প্রখম আলো :: কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দুর্গম একটি গ্রাম হলদ্যাশিয়া।

এ গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। পাহাড়ঘেরা গ্রামটির চারদিকে রাবার বাগান। পুরুষদের পেশা দিনমজুরি।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সময় এই গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আইয়ুব, ফরিদুল আলমসহ আরও কয়েকজনের কাছে আর্থিক ও খাদ্যসহায়তা এবং চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করা হয়।

এর প্রায় এক মাস পর তাঁদের পটিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পাশের একটি দোকানে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে ইংরেজিতে লেখা নথিপত্রে স্বাক্ষর ও টিপসই নেওয়া হয়।

এরপর ২০২৩ সাল থেকে তাঁদের নামে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ঋণের নোটিশ আসা শুরু হয়। তখন তাঁরা বুঝতে পারেন স্বাক্ষর ও টিপসই দিয়ে ফেঁসে গেছেন।

তাঁরাসহ ইউসিবি ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের চিঠি পেয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, ঈদগড় ও গর্জনিয়া ইউনিয়নের ২২ জন নারী-পুরুষ। তাঁরা সবাই হতদরিদ্র-দিনমজুর ও ভূমিহীন।

২০২৩ সাল থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের চিঠি এসেছে তাঁদের কাছে।

এই ২২ জনের নামে ২৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে ইউসিবিএলের চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী, চকবাজার ও চট্টগ্রাম বন্দর শাখা থেকে।

এই ঋণ জালিয়াতির নেপথ্যে রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের পরিবার।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেন।

সেই অর্থে বিশ্বের একাধিক দেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তাঁরা। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে এই সাবেক মন্ত্রীর পরিবারের সম্পদ জব্দও করা হয়েছে।

যেভাবে ঋণের ফাঁদ পাতা হয়

কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঈদগড়ের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ও  নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীর নুরুল বশর হতদরিদ্রদের কাছ থেকে এনআইডি সংগ্রহ করে দেওয়ার দায়িত্ব পান।

তাঁরা পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এনআইডি সংগ্রহ করেন। একসময় তাঁরা নিজেরাও ঋণের ফাঁদে পড়েন। মিজানুর রহমান ৯ কোটি টাকা ও নুরুল বশর ১৩ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন।

মিজানুর রহমান বলেন, ঈদগড়ের পানিস্যাঘোনা এলাকার আবুল কালাম তাঁদের দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন। আবুল কালাম নুরুল বশরের ভগ্নিপতি। অর্থসহায়তা ও চাকরির কথা বলে কালাম এনআইডি সংগ্রহ করেন।

নুরুল বশর বলেন, তাঁর ভগ্নিপতি আবুল কালামের ফাঁদে পড়ে তিনি এখন এলাকাছাড়া। আবুল কালাম বর্তমানে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বসবাস করেন।

আবুল কালামের কথা অনুযায়ী পটিয়ায় গিয়ে তাঁরা মোস্তাফিজুর রহমান, মো. শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর কাগজে সই করেন।

পটিয়ার এই তিন ব্যক্তি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের হয়ে কাজ করেন বলে জেনেছেন তাঁরা। এলাকায় তাঁরা ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত।

এ প্রসঙ্গে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা করার পর সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন।

বাইশারী ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, প্রতারণার ফাঁদে পড়া মানুষগুলো দিনমজুর ও ভূমিহীন। বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা ইউপি কার্যালয়ে এসে ধরনা দিচ্ছেন।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেল

পাহাড়ঘেরা হলদ্যাশিয়া গ্রামের রাবার বাগানের দক্ষিণ পাশে দিনমজুর মোহাম্মদ আয়ুবের টিনের ছাউনির ঝুপড়ি ঘর। স্ত্রী, দেড় থেকে দশ বছর বয়সী দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে আয়ুবের টানাটানির সংসার।

দুর্গম এই গ্রামের দিনমজুর মোহাম্মদ আয়ুবকে ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে ইউসিবি। তাঁর ঋণের পরিমাণ ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।

সম্প্রতি আয়ুবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাড়ির আঙিনায় গৃহস্থালির টুকিটাকি কাজ সারছিলেন।

ঋণ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেনশনে রাতে ঘুমাইতে পারি না। জীবনে একসঙ্গে ১ লাখ টাকা দেখি নাই। ৬ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে কীভাবে নিলাম, বুঝতে পারতেছি না।’

মোহাম্মদ আয়ুব জানান, ১৪৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হলে তাঁর গাড়ি ভাড়া জোগাড় করতে কয়েক দিন লেগে যায়।

এত দূরের শহরে তাঁর নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে জেনে তিনি বিস্মিত হন।

তবে অর্থসহায়তা ও চাকরির কথা বলে এলাকার কিছু মানুষ তাঁর কাছ থেকে এনআইডি নিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তারাই হয়তো এ কাজ করেছে।

তিনি কখনো চট্টগ্রাম শহরের ইউসিবি ব্যাংকের কোনো শাখায় যাননি।

গত ২৫ জুলাই ব্যাংকটির তিন কর্মকর্তা এসেছিলেন বাইশারীর হলদ্যাশিয়া গ্রামে। তাঁরা ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আয়ুবের কাছেও গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

যাঁদের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তাঁদের সহায়-সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন। সবাইকে চট্টগ্রামে গিয়ে ব্যাংক হিসাব হালনাগাদ করতে বলেছেন।’

বাড়ির আঙিনায় বসে কথা বলতে বলতে দুশ্চিন্তায় ডুবে যান মোহাম্মদ আয়ুব। বলেন, ‘বাইশারী থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই নেই আমাদের কাছে।

ব্যাংকে যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাই তো জানি না। আবার ঋণও নাকি আমাদেরই পরিশোধ করতে হবে।’

হলদ্যাশিয়া গ্রামের আরেক দিনমজুর মো. ফরিদুল আলমের ঘরে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে। লোকজনের বাড়িতে বাঁশের বেড়া তৈরি করে সংসার চালান।

তাঁর নামেও ইউসিবি চট্টগ্রামের বন্দর শাখা থেকে পাঠানো হয় ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকার বকেয়া ঋণ পরিশোধের নোটিশ।

নোটিশে ফরিদুল আলমকে চট্টগ্রাম জুবিলি রোডের ইউনিক এন্টারপ্রাইজের মালিক দেখানো হয়।

২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই নোটিশে স্বাক্ষর করেন পোর্ট শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মো. আরিফ হোসেন।

দরিদ্র ফরিদুল আলমের (৩৯) কাছে ইউনিক এন্টারপ্রাইজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি হেসে ওঠেন। প্রতিষ্ঠানটির নামও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘হ, শুনছি, আমি নাকি কিসের মালিক।’ চট্টগ্রামে তাঁর কোনো ব্যাংক হিসাব নেই বলেও জানালেন তিনি।

ফেঁসে গেছেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই

হলদ্যাশিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রামুর ঈদগড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব রাজঘাট গ্রাম। গ্রামের এক পাশে দিনমজুর নুরুল ইসলামের টিনের বাড়ি। সংসারে স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে।

নুরুল ইসলাম (৪৮) বলেন, কয়েক মাস আগে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মায়মুনা আক্তারের নামে ইউসিবি চট্টগ্রামের চকবাজার শাখা থেকে দুটি নোটিশ আসে।

ওই নোটিশগুলো স্থানীয় শিক্ষিত লোকজনকে পড়তে দিয়ে জানতে পারেন, তাঁর (নুরুল) নামে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে; যা সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

তাঁর স্ত্রী মায়মুনাও একই ধরনের নোটিশ পেয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে ব্যাংক থেকে ঋণের বোঝা চাপানো হয় ১৩ কোটি টাকা; যা সুদসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা।

নোটিশে নুরুল ইসলামকে বলা হয়েছে চট্টগ্রামের ইসলাম ট্রেডার্স এবং পটিয়ার কিছু জমির মালিক।

নুরুল ইসলামের পাশে আরেক দিনমজুর মো. জহির উদ্দিনের বাড়ি। জহির উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমার নামে একই ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধের নোটিশ পাঠানো হয়।

নোটিশে জহির উদ্দিনের নামে ‘জহির ইন্টারন্যাশনাল’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখানো হয়।

জহির উদ্দিন অবাক হয়ে বলেন, ‘দিনমজুরি করে সংসার চালাই, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোথায় পাব।’

নেপথ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পরিবার

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ইউসিবি ব্যাংক ছিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। তখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুখমিলা জামান।

নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুজ্জামানের ছোট ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি। তাঁদের নির্দেশনায় নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ মঞ্জুর করা হতো।

ব্যাংকটির তখনকার কর্মকর্তারা ছিলেন এসব জালিয়াতির সহযোগী। সরকার বদলের পর থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিবারের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা পলাতক রয়েছেন।

ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পটিয়া এলাকার দীর্ঘ সময় সংসদ সদস্য ছিলেন।

এসব এলাকার লোকদের ব্যবহার করেই তাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেন। তাঁদের পক্ষে যাঁরা এনআইডি সংগ্রহ করতেন, তাঁরা সবাই পটিয়ার।

২২ হতদরিদ্রের নামে ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউসিবি ব্যাংকের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা জীশান কিংশুক হক বলেন, ‘এসব অনিয়ম-দুর্নীতি গত পরিচালনা পর্ষদের সময়ে হয়েছে।

আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। হতদরিদ্র-দিনমজুর হলেও তাঁরা কিছু টাকাও যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদেরও দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে ধরা হবে। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।’

56 ভিউ

Posted ১:৫৩ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

SunMonTueWedThuFriSat
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30 

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : Shaheed sharanee road, cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com