কক্সবাংলা ডটকম(১৮ মার্চ) :: দুই বলে প্রয়োজন ছয় রান। স্ট্রাইকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। স্কয়ার লেগ দিয়ে বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন এ অলরাউন্ডার। এক বল ও ২ উইকেট হাতে রেখে ফাইনালে পৌঁছল বাংলাদেশ। যেন স্বপ্নের রাজ্যে ভেসে বেড়ানো। শ্রীলংকার বিপক্ষে অঘোষিত ‘সেমিফাইনালে’ এমন স্বপ্নই সত্যি করে দেন মাহমুদউল্লাহ।
নিদাহাস টি২০ ট্রফির ফাইনালের আগে বাংলাদেশকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে রূঢ় এক বাস্তবতার। ছোট দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে সাত মোকাবেলায় ভারতকে একবারও হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। এ প্রতিযোগিতায়ও দুই ম্যাচের দুটিতেই হার। ফাইনালে ভারতকে হারানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ আজ টাইগারদের সামনে।
ভারতকে হারানোর অসাধ্য সাধনের পথে অঘোষিত ‘সেমিফাইনাল’ বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকছে। যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাহমুদউল্লাহরা শ্রীলংকাকে হারালেন, তা যেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি।
ভারতের বিপক্ষে ‘টি২০’ বললে এই মাহমুদউল্লাহর নামই মনে আসে সবার আগে। ২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জেতা ম্যাচ হাতছাড়া করেছিলেন তিনি। সেই মাহমুদউল্লাহও বদলে গেছেন অনেকটাই। আজ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কলম্বোয় ভারতের বিপক্ষে পুরনো সেই হারের ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে চাইবেন তিনি।
মাহমুদউল্লাহ ছাড়া মুশফিকুর রহিমও আছেন দারুণ ফর্মে। এ টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানও মুশফিক। চার ম্যাচে ৯৫.০০ গড়ে তার রান ১৯০। যার মধ্যে আছে শ্রীলংকার বিপক্ষে ২১৪ রান তাড়া করে জেতার পথে ৭২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। এছাড়া রানের মধ্যে আছেন ওপেনার তামিম ইকবালও। সর্বশেষ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ ৫০ রান।
এ ম্যাচের আগে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার নাম সাব্বির-সৌম্যর ছন্দহীন ব্যাটিং। এ টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত বড় কোনো অবদান নেই তাদের। সৌম্যর টি২০-এর ধারাবাহিকতাও দেখা যায়নি এ টুর্নামেন্টে। আর সাব্বির তো অফ ফর্মে অনেকদিন ধরেই। এছাড়া শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে লিটন দাস দারুণ একটি ইনিংস খেললেও পরের ম্যাচগুলোয় ধরে রাখতে পারেননি সেই ধারাবাহিকতা। তাই ফাইনালে এ তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যানের রানে ফেরার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
পাশাপাশি দলের আরেক দুশ্চিন্তার নাম ডেথ ওভারে বোলিং। শ্রীলংকার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে দারুণভাবে শুরু করেছিল বাংলাদেশের বোলাররা। কিন্তু শেষদিকে গিয়ে উদারভাবে রান বিলিয়েছেন মুস্তাফিজরা। প্রথম ১০ ওভারে ৫৩ রান দেয়া বাংলাদেশ শেষ ১০ ওভারে দিয়েছে ১০৬ রান। এর আগে ভারতের বিপক্ষে হারা ম্যাচেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেষদিকের বাজে বোলিং। তাই ভারতের বিপক্ষে জিততে ধারাবাহিকভাবে ভালো বোলিংয়ের বিকল্প নেই।
তবে এসব ভুল শুধরেই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালের অপেক্ষায় এখন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তিনি মনে করেন, লংকানদের বিপক্ষে জয়ী ম্যাচের মতোই উত্তেজনা ছড়াবে ফাইনালের লড়াই। পাশাপাশি খর্বশক্তির দল হলেও ভারতকে যথেষ্ট সমীহ করছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘এ টুর্নামেন্টের শুরুতে সবার কাছে বার্তা ছিল পজিটিভ থাকতে। প্রথম ম্যাচে যে মাইন্ডসেট ছিল, কালও (আজ) সেটা নিয়ে মাঠে নামব। জয়ের জন্য সেরাটা দিয়েই খেলব।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভারত সবসময় খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। ওরা খুব পেশাদার এবং তাদের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ। তাদের কিছু সিনিয়র ক্রিকেটার আছেন, যারা আইপিএলেও ভালো ক্রিকেট খেলেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা ভালো খেলতে পারেন। যেটা হয়তো আমাদের দলে অনেকের ১০-১২ বছর খেলার পরও সে অভিজ্ঞতা নেই।’
এদিকে মিরপুরে ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও বলেছেন, ভারতের চার খেলোয়াড়কে নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশের। ওয়াশিংটন সুন্দর, যুজবেন্দ্র চাহাল, রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ানকে নিয়ে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক।
এছাড়া এ ম্যাচের আগে টসটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ টুর্নামেন্টে মাত্র একটি ম্যাচে আগে ব্যাট করা দল জয় পেয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত টস ভাগ্যটা কার পক্ষে হাসে, তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। সব মিলিয়ে মাঠ ও মাঠের বাইরের নানা সমীকরণ মাথায় রেখেই এখন পরিকল্পনা সাজাতে হবে বাংলাদেশকে।
সাকিবকে ফাইনালে সাসপেন্ড করতে শ্রীলঙ্কার আবেদন
নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের দারুণ জয়ের আগে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও রিজার্ভ খেলোয়াড় নুরুল হাসান। এ কারণে তাদের ম্যাচ ফি’র ২৫ শতাংশ জরিমানা করেছেন ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড। শুক্রবার (১৬ মার্চ) তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই শাস্তিতে খুশি নয় শ্রীলঙ্কা। তারা লিখিতভাবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিকে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে।একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘শ্রীলঙ্কা ড্রেসিং রুমের কাচ ভাঙা নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। তাদের চাওয়া, শাস্তি বাড়িয়ে সাকিবকে যেন অন্তত ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে সাসপেন্ড করা হয়।’ তবে এ বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও সূত্রটি জানায়।
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ড্রেসিং রুমের মধ্যে থাকা কোনও বাংলাদেশি খেলোয়াড় ভেঙেছেন দরজার কাচ। বাইরের দিকে মুখ করে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বাংলাদেশ দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ড্রেসিং রুম থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই মুহূর্তেই ভেঙেছে দরজার কাচ। তবে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যে ইচ্ছে করে দরজা ভাঙেননি, সেটা অবশ্য উঠে এসেছে প্রাথমিক অনুসন্ধানে।
এদিকে ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড রিপোর্টে বলেছেন, ‘শুক্রবারের ঘটনা ছিল হতাশাজনক। ক্রিকেটের কোনও পর্যায়ে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে এমন আচরণ কাঙ্ক্ষিত নয়। আমি জানি, এখানে উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু দুই খেলোয়াড়ের এমন কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য। যদি চতুর্থ আম্পায়ার সাকিবকে না থামাতেন ও মাঠের আম্পায়ার যদি থিসারা পেরেরা ও নুরুল হাসানকে না আটকাতেন, তাহলে আরও খারাপ কিছু ঘটতে পারতো।’
শনিবার (১৭ মার্চ) সকালে নিজেদের দোষ স্বীকার করেছেন সাকিব ও নুরুল। শাস্তিও মেনে নিয়েছেন তারা। তাই শুনানির দরকার নেই বলে জানান ম্যাচ রেফারি।
বাংলাদেশের ইনিংসের ১৯.২ ওভারের সময় লেগ আম্পায়ার নো বল কল দিলেও পরে দুই আম্পায়ার মিলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে মাহমুদউল্লাহ ও রুবেল হোসেনকে মাঠ ছেড়ে আসার ডাক দেন সাকিব।
এর কিছুক্ষণ আগে রিজার্ভ খেলোয়াড় নুরুল হাসান পানি নিয়ে মাঠে ঢোকার পর শ্রীলঙ্কার কুশল মেন্ডিসের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ম্যাচ শেষেও ছিল সেই উত্তাপ। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক থিসারা পেরেরার দিকে আঙুল উঁচিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলাদেশের এই উইকেটরক্ষক।
টাইগারদের জন্য কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা
দুর্দান্ত ছক্কায় অবিস্মরণীয় জয়ের পর থেকে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ দল। এবার তাদের আনন্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। বাংলাদেশ দলের জন্য এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তিনি।
শনিবার সকালে কলম্বোতে তিনি এই ঘোষণা দেন। রোববার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে জিতলে পুরস্কারের টাকার অঙ্ক আরও বাড়বে বলে জানান পাপন।
অবিস্মরণীয় জয়ের পর বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া দেশ ও বিদেশের অনেক নামিদামি ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ দলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ছক্কায় শেষ পর্যন্ত যে জয়টি এসেছে, তা কেবল একটি জয় ছিল না! তা ছিল ভেতরে পুষে রাখা বহুদিনের যন্ত্রণা ও ক্ষোভ থেকে ‘বিষ’ হয়ে ওঠা সাপের ছোবল। ম্যাচ শেষে যার প্রতিটি ছোবলে নীল হয়েছে শ্রীলংকা।
শুক্রবার কলম্বোর আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে শ্রীলংকাকে ২ উইকেটে হারিয়ে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। লংকার সামনে জয়ের জন্য যে ক্ষুুধার্ত বাংলাদেশকে দেখা গেছে, তারা উপহার দিয়েছে এমন এক অবিস্মরণীয় সমাপ্তির ম্যাচ, যাকে অভিহিত করা যায় ২০১৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল-পরবর্তী সেরা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হিসেবে। আর কলম্বোয় টগবগে এই বাংলাদেশই রোববার ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে লড়বে।