কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৮ অক্টোবর) :: বাংলাদেশী পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্থানগুলোর মধ্যে সবার ওপরেই থাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নাম। বেশিরভাগ মানুষই এক কথায় এই দ্বীপটাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন স্পট হিসেবে মেনে নেন নির্দ্বিধায়। সাগরের বুকে জেগে থাকা ছোট্ট এই দ্বীপটাকে তাই পর্যটনের মৌসুমে সামলাতে হয় বিপুল সংখ্যক ‘ঘুরতে যাওয়া’ মানুষের চাপ।
আর পর্যটকের চাপে বিপন্ন হতে চলা সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০১৯ সালের ১ মার্চ থেকে দ্বীপে সীমিত পরিসরে রাত্রিযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েও স্বল্পসংখ্যক মুনাফালোভী পর্যটন ব্যবসায়ীদের চাপে আবারও পিছু হটেছে সরকার। আর এ সিদ্ধান্তের ফলে দ্বীপের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
জানা যায়,নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল করে। এই সময় সাগরও বেশ শান্ত থাকে, ফলে এই দ্বীপে ভ্রমণের সেরা সময় এটাই। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয় টেকনাফে, সেখান থেকে জাহাজে চড়ে সেন্টমার্টিনে। আর প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে সেন্ট মার্টিনে বেড়েই চলেছে অতিরিক্ত মানুষের চাপ। প্রতিদিন ৬/৭টি প্রমোদতরি ও ২০টির বেশি কাঠের ট্রলার নিয়ে প্রতিদিন সেন্ট মার্টিন যায় ৫ হাজারের বেশি পর্যটক। নভেম্বর থেকে পুরোদমে জাহাজ চলাচল চালু হলে লোকসমাগম বেড়ে যাবে।যার ফলে সৈকতের বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টনীর কেয়াবন, নিশিন্দা, গাঙ লতাসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে এভাবে লোকসমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন পরিবেশ অধিদপ্তর।
কক্সবাজারের স্থানীয় পরিবেশবাদীদের অভিযোগ,অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও দূষণের কারণে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এছাড়া ভাঙনে ক্ষয় হয়ে প্রতি বছর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এ দ্বীপটি।বেশির ভাগ পর্যটক সেখানকার ১০৬টি হোটেল-কটেজে থাকেন। অথচ কোনো হোটেলে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নেই। হোটেল বর্জ্য চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। এতে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জল ঘোলাটে হচ্ছে। প্রমোদতরির ইঞ্জিনের পাখার (প্রপেলার) কারণে সমুদ্রের তলদেশের বালু পানিতে মিশে প্রবালের ওপর জমে আস্তরের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বিশাল প্রবাল এলাকা মরে যাচ্ছে।
গতবছর পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দ্বীপটির পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ২০ হাজার পর্যটক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের চাহিদা মেটাতে দ্বীপের ভূগর্ভে থাকা পানি তুলে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। যে কোনো সময় ভূগর্ভের ফাঁকা স্থানে সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকে পড়তে পারে। এর ফলে দেশের সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আধার দ্বীপটি ধ্বংস হয়ে যাবে। পর্যটকদের মলমূত্র ও বর্জ্যের কারণে দ্বীপটির পানিতে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দ্বীপটিতে ১৫৪ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৯১ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৩৪ প্রজাতির মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। দ্বীপে ৭৭ প্রজাতির স্থানীয় পাখি, ৩৩ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিসহ মোট ১১০ প্রজাতির পাখি ও ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল। এখন অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়,মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকের উপস্থিতির পাশাপাশি তাঁদের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে দ্বীপের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও আবর্জনা সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। দ্বীপটিতে উদ্বেগজনক হারে বসতি স্থাপন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার হওয়ায় পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দ্বীপের প্রবাল, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। হোটেল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জল। আর সৈকতে কোলাহল বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে ছুটে আসা মা কচ্ছপও ডিম দিতে পারছে না।
অপরদিকে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জানান, এই দ্বীপে আবাদি জমির পরিমাণ ৪১৬ একর। এর মধ্যে ৬২ একর জমিতে নারকেল বাগান থাকলেও খাদ্য, বাসস্থান এবং পশু পালনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও কিছু লোক অতি লোভে সৈকতের বালিয়াড়িতে দোকানপাট তৈরি করে ব্যবসা করেন। আয়–রোজগার বন্ধ হলে সমস্যা হবে-তাই এসব দোকানপাট উচ্ছেদ করা যায় না।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে সেখানে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন্য প্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও আইন লঙ্ঘন করে শতাধিক হোটেল-মোটেল তৈরি হয়েছে।আর লোকবল-সংকট দেখিয়ে কক্সবাজার শহর থেকে সেন্ট মার্টিনে গিয়ে এসব তদারকি করছে না পরিবেশ অধিদপ্তর।
৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে রয়েছে ১৫৪ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৬৮ প্রজাতির প্রবাল এবং ১১০ প্রজাতির পাখি ও ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার।
আবারও পর্যটন মৌসুম শুরু
——————–
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের মাধ্যমে চলতি বছরের পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। এক মাস আগে শুরু হওয়ায় হোটেল মালিকদের আশা ছিল মৌসুমে দলে দলে আসবেন পর্যটকেরা। অথচ তেমনটি ঘটেনি। কারণ সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ। মূলত সেন্ট মার্টিন দেখতেই অধিকাংশ পর্যটক কক্সবাজার আসেন। আগামী শুক্রবার ১ নভেম্বর থেকে আবারও পাঁচটি পর্যটকবাহী জাহাজ টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে চলাচল শুরু করবে। প্রবাল দ্বীপটিতে এখন রাত্রিযাপনেও নেই কোনো বাধা। এ কারণে শুক্রবার থেকে কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামবে বলে আশা করছেন কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল মালিকেরা।
হোটেল–মোটেল মালিকেরা বলছেন, সেন্ট মার্টিন বেড়াতে ইচ্ছুক পর্যটকেরা প্রথমে কক্সবাজারে আসেন। সেখান থেকেই যান সেন্ট মার্টিনে। এ জন্য সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচল চালু থাকলে কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ে।
কক্সবাজার কটেজ গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি কাজী রাসেল আহমদ বলেন, গত বছর অক্টোবর মাসে দুই লাখের বেশি পর্যটক এসেছিলেন। তখন ৭০ শতাংশ পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেন। এখন পুরো অক্টোবর মাসে ২০ হাজার পর্যটক আসেননি। কারণ সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ। সেন্ট মার্টিনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটনব্যবসা। লাখো পর্যটককে বরণ করতে প্রস্তুত আছে কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল, কটেজ ও গেস্টহাউস।
জাহাজ মালিকদের দৌঁড়ঝাপ
গত ২০ অক্টোবর থেকে সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আবহাওয়ার প্রভাবের কারণে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়নি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। আগামী ১ নভেম্বর থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল শুরু হবে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে পাঁচটি জাহাজ টেকনাফের নাফ নদীর কেরনতলীর ঘাটে প্রস্তুত রয়েছে। জাহাজগুলো হচ্ছে, কেয়ারি সিন্দাবাদ, এমভি ফারহান ক্রুজ, এমভি দোয়েল পাখি, এমভি পারিজাত ও কেয়ারি ডাইন।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সেন্ট মার্টিনে যাতায়াতের অনুমতি চেয়ে ইতিমধ্যে পাঁচটি জাহাজের মালিক আবেদন করেছেন। কিন্তু আবহাওয়া পরিস্থিতি ভালো না থাকায় জাহাজগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতিবেদন সাপেক্ষে নভেম্বরের প্রথম দিকে জাহাজগুলো চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে। গত মৌসুমে অক্টোবর থেকেই এ নৌপথে চলাচল করেছিল নয়টি জাহাজ। এরপর মার্চ পর্যন্ত চলে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ। এপ্রিল থেকে সমুদ্র উত্তাল হলে জাহাজ চলাচল কয়েক মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
রাত্রিযাপনে বাধা নেই
———————
২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের রাত্রিযাপন করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মতে দুটি জাহাজে ৫০০ জন পর্যটক সেন্ট মার্টিন যেতে পারবেন এবং তাঁদের যাওয়ার আগে অনলাইনে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। কিন্তু নানা কারণে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। এখন সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপনে সমস্যা নেই।
এ প্রসঙ্গে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, নানা কারণে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত চলতি বছর কার্যকর করা যাচ্ছে না।
তবে সেন্ট মার্টিন হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, হঠাৎ করে পর্যটক বন্ধ করা হলে স্থানীয়দের ক্ষতি হবে। সেখানে রাত্রিযাপন করতে না দিলে পর্যটকেরা উৎসাহ হারাবেন। তখন কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
Posted ১২:৫৬ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta