
কক্সবাংলা ডটকম(১৩ ডিসেম্বর) :: কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি বাজারের ঊর্ধ্বমুখিতা ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে ব্যয় বেড়েছে ব্যবসার। বাড়তি এ ব্যয় সামলাতে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বড় কোম্পানিগুলোর ঋণের পরিমাণ এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ছে।
কোনো কোনো কোম্পানির ঋণের পরিমাণ এক বছরে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি বেড়েছে বলে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ঋণের পরিমাণ বাড়লেও এখন পর্যন্ত ব্যাংকের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর লেনদেন ভালো অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শীর্ষ বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ব্যাংকঋণের পাশাপাশি ইজারা, অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার ও পুঞ্জীভূত সুদের পরিমাণ বিবেচনা করা হয়েছে। যেসব কোম্পানির ঋণ এক বছরে ৫০০ কোটি টাকার কম বেড়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সব মিলিয়ে দেখা গিয়েছে, এক বছরে ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা বা এর বেশি বেড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়টি বেসরকারি কোম্পানির।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ইস্পাত খাতের বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম)। ২০২১ সালের জুন শেষে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের জুন শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮২২ কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা।
ইস্পাত খাতে বিএসআরএম গ্রুপের আরেক কোম্পানি বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ এ সময় বেড়েছে ৭৭৮ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের জুন শেষে কোম্পানিটির ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ৪ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এ বছরের জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, উৎপাদনে ব্যয় বাড়ার কারণে ঋণ নেয়ার পরিমাণও বাড়ছে। অন্যদিকে ডলারের বিনিময় হারও অনেক বেড়েছে। আগে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারেও এখন কাঁচামালের দাম অনেক বেশি।
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির ঋণ স্থিতি ২০২১ সালের জুন শেষে ছিল ২ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪ হাজার ৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ১৫ মাসে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা।
টেলিযোগাযোগ খাতের বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেডের ঋণ নয় মাসে প্রায় ১ হাজার ১২ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা, যা এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রায় ৪ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২০২১ সালের জুন শেষে ছিল ২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ২৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ১৫ মাসে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৯১৯ কোটি টাকা।
জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ এক বছরে ৯০০ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সালের জুন শেষে কোম্পানিটির ঋণ ছিল প্রায় ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। এ বছরের জুন শেষে তা প্রায় ৪ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম এখন কমে এলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে ডলারের বিনিময় হার।বিদেশ থেকে কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে দাম যতটা না কমেছে,ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর প্রভাবেই ব্যবসার ব্যয় বেড়ে তা এখন ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২০২১ সালের জুন শেষে ছিল ৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৩২৮ কোটি টাকায়। ১৫ মাসে কোম্পানিটির ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বেক্সিমকো লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে, তাই ঋণের পরিমাণও বাড়ছে।’
এসিআই লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ গত বছরের জুন শেষে ছিল ৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির ঋণ বেড়ে ৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ১৫ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির ঋণ বেড়েছে ৮৯৬ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২০২১ সালের জুন শেষে ছিল প্রায় ১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৫ কোটি টাকায়। ১৫ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির ঋণ বেড়েছে ৬৫৪ কোটি টাকা।
বিএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাত, ওয়ালটন, সামিটের মতো কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের। ব্যাংকটি থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়ে বিনিয়োগও করেছে এসব কোম্পানি।
এসব কোম্পানির ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাতের মতো কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক পরিধি বড় হয়েছে। এ কারণে কোম্পানিগুলোর ঋণ বাড়তে পারে।
আবার কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বাড়ার কারণেও ঋণ বেড়েছে। ওয়ালটনের মতো কোম্পানিগুলোর বিক্রি থেকে আদায় না বাড়লে চলতি মূলধনি ঋণ বেড়ে যায়। তবে আমাদের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর লেনদেন ভালো।’

Posted ২:২০ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta