
কক্সবাংলা ডটকম :: নির্দিষ্ট পণ্য ও বাজারে ভর করে চলছে দেশের রপ্তানি খাত। কোনো দাওয়াইয়ে যেন এ বালাই ঘুচছে না। প্রচলিত বাজার নির্ভরতা দিন দিনই বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে নির্দিষ্ট বাজার নির্ভরতা আরও কিছুটা বেড়েছে। বিপরীতে কমছে নতুন বাজারের হিস্যা। নির্দিষ্ট পণ্য ও বাজারনির্ভরতার কারণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য।
নির্দিষ্ট এসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে রপ্তানি বন্ধ কিংবা ব্যাপক ধসের আশঙ্কা থাকে।
অতিমারি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর বড় উদাহরণ। ওই দুই ঘটনায় ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যায়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যউপাত্ত বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি আগের গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে।
এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারের রপ্তানি বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম, মাত্র শূন্য দশমিক ৭৭ শতাংশ। প্রচলিত বাজারে রপ্তানি বেড়েছে অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের চেয়ে চার গুণ।
অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে টিইএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহিল নাকিব বলেন, অনেক কারণে অপ্রচলিত শ্রেণির বাজারে রপ্তানি কমছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘটনা সারা বিশ্বের বাণিজ্যে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে।
এতে দেশভিত্তিক শুল্ক আরোপ হওয়ায় অনেক দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আর লাভজনক নয়। এ কারণে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ানোর চেষ্টা করছে এসব দেশ। অপ্রচলিত শ্রেণির বেশির ভাগ দেশেই এ পরিস্থিতি।
এছাড়া ক্রেতাদের মধ্যেও একটা ধীর চলো নীতি দেখা যাচ্ছে। আবার মার্কিন শুল্কের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারাও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বড় রপ্তানি বাজার নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সে কারণে অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানির গতি বেশ মন্থর।
নতুন বাজারে রপ্তানিতে যে নগদ সহায়তা দেওয়া হতো সরকারের পক্ষ থেকে তা কমিয়ে দেওয়াও একটা বড় কারণ। তবে অবস্থা এরকম থাকবে না। কারণ প্রচলিত বাজার ঝুঁকি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতেই হবে।
নগদ সহায়তা কমানোর প্রভাব
দেশের রপ্তানি বাণিজ্য উৎসাহিত করতে ৪৩টি পণ্য ও খাতে নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুসারে এটি রপ্তানি ভর্তুকি হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বল্পোন্নত দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কোনো ধরনের নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হবে।
এর কারণে বিভিন্ন খাতে নগদ সহায়তার হার অল্প অল্প করে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন হার অনুযায়ী, নতুন বাজারে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ নগদ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যান্য খাতেও নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে।
প্রচলিত ও অপ্রচলিত বাজার কোনগুলো
১৯৭৮ সালে ফ্রান্সে ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি দিয়ে পোশাক রপ্তানিতে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। সেই শুরুর পর থেকে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যকেও প্রচলিত বাজার হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাকের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ থেকে ৮৪ শতাংশ আসে প্রচলিত বাজার থেকে।
বাকি দেশগুলোকে অপ্রচলিত বা নতুন বাজার বলা হয়ে থাকে। এসব বাজারের হিস্যা ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে এসব বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছেই। চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে ৯৯৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারের রপ্তানি হয় মাত্র ১৬৬ কোটি ডলারের কিছু কম। রপ্তানির বাকি পরিমাণ এসেছে প্রচলিত বাজার থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ
একক দেশে হিসেবে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম দফায় ১০ ও দ্বিতীয় দফায় ২০ শতাংশসহ মোট ৩০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পরও গত প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশের মতো। মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০১ কোটি ১৭ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ১৮৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার।
রপ্তানি বেড়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের পোশাক আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের হিস্যা বেড়ে হয় ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই প্রান্তিক এ হার ছিল ১৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশটিতে এক সময় ওভেন শার্ট-প্যান্টের রপ্তানি বেশি হারে বেড়েছে। তবে গত বেশ কিছু দিন ধরে নিট বা গেঞ্জি জাতীয় পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি। গত প্রান্তিকে নিটের রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময় ওভেনের রপ্তানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
প্রচলিত অন্য বাজারের মধ্যে কানাডায় রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ৩০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে রপ্তানি ৩৪ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ। ১১৪ কোটি ডলার থেকে বেড়ে রপ্তানি হয়েছে ১২২ কোটি ডলার।
একই রকম গতিপ্রবাহ প্রচলিত বাজারের মধ্যে জোটগত প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশে। ইইউতে রপ্তানি বেড়েছে ৪ শতাংশের মতো। ৪৭৫ কোটি ডলার থেকে রপ্তানি বেড়ে ৪৭৮ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
প্রচলিত বাজারে এই গতিপ্রবাহের বিপরীতে বাংলাদেশের নতুন রপ্তানি বাজার হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে রপ্তানি ক্রমশ তলানিমুখী। প্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানির হিস্যা বাড়ার বিপরীতে কমছে নতুন বাজারের হিস্যা। গত প্রান্তিকে এসব বাজারের হিস্যা কমে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৬ কোটি ডলারের কিছু কম, যা আগের একই সময়ে ছিল ১৬৪ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
অপ্রচলিত শীর্ষ ১০ বাজার
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে রপ্তানির পরিমাণের দিক থেকে প্রচলিত বাজারের বাইরে শীর্ষ ১০ রপ্তানি বাজারের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, ভারত, সৌদি আরব, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চিলি, তুরস্ক, রাশিয়া।
এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার জাপানে গত প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশের মতো। রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। দ্বিতীয় প্রধান বাজার ভারত। দেশটিতে গত প্রান্তিকে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ২১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের মতো।
তৃতীয় প্রধান বাজার অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি কমে গেছে আগের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশের বেশি। রপ্তানি হয়েছে ২০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক। শীর্ষ দশের অন্যান্য বাজারের মধ্যে ব্রাজিলে রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চার কোটি ৪৭ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। মালয়েশিয়ায় রপ্তানি কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের।
মেক্সিকোতে রপ্তানি বেড়েছে ২২ দশমিক ১৬ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৭ কোটি ১২ লাখ ডলারের। সৌদি আরবে রপ্তানি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। রপ্তানি হয় ৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক।
অপ্রচলিত বিভিন্ন বাজার থেকে হতাশাজনক রপ্তানি আয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম চীন। বাংলাদেশে অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের (বিইএ) উপাত্ত থেকে দেখা যায়, গত প্রান্তিকে চীনে রপ্তানি বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রেকর্ড ৬০ শতাংশ। তিন মাসে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৭ কোটি ১৫ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, চীনে রপ্তানি এতটা বাড়ার একাধিক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অন্যান্য দেশের মতো চীনেও এতদিন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক বাজারজাত হতো।
এতে এক একটি পণ্যের দাম অনেক বেশি দাঁড়াতো। সম্প্রতি চীনা আমদানিকারকরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আমদানি শুরু করেছে। এতে পণ্যের দর অর্ধেকের মতো কমে এসেছে। দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় চীনে হঠাৎ করে এত বেশি হারে রপ্তানি হয়েছে। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে আশা করি।
এছাড়া ১৪১ কোটি জনসংখ্যার দেশে চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে তৈরি পোশাকের যে চাহিদা তার একটা বড় জোগান আসত স্থানীয়ভাবে। এখন আর স্থানীয়ভাবে সেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চীন ক্রমেই তৈরি পোশাক উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে চীনে।
বিইএর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ওভেন বা শার্ট প্যান্টের রয়েছে একচেটিয়া দাপট। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ওভেনের রপ্তানি বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে নিটের রপ্তানি কমে গেছে ৪ শতাংশের মতো। এ সময় ওভেনে রপ্তানির পরিমাণ ৬ কোটি ডলারের মতো। অন্যদিকে নিটে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৮ লাখ ডলার।

Posted ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta