কক্সবাংলা ডটকম(১৫ আগস্ট) :: অপ্রশস্ত সড়ক। গণপরিবহনের দৈন্যদশা। যানজট এখানকার নিত্যদিনের চিত্র। ফিটনেসবিহীন পুরনো যানবাহনের দূষণে ভারি নগরের বাতাস। চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। সংকট আবাসন ও শিক্ষা খাতেও। দৈনন্দিন নাগরিক জীবনে নাভিশ্বাস। সব মিলিয়ে এই হলো রাজধানী ঢাকার চিত্র। মহানগরীটির বসবাসযোগ্যতা এখন নেমে এসেছে তলানিতে। বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীগুলোর বসবাসযোগ্যতা সূচকেও দেখা যাচ্ছে এর প্রতিফলন।
দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স-২০১৮’ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বসবাসের জন্য এখন বিশ্বের দ্বিতীয় জঘন্যতম নগরী ঢাকা।
স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো— এ পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ১৪০টি নগরীর তালিকা করে দেখা গেছে, ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম।
বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। অন্যদিকে বিশ্বে বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা।
বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে ক্রমেই নিচে নামছে ঢাকা। গত বছর ঢাকা ছিল চতুর্থ জঘন্যতম নগরী। ২০১৭ সালের গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সেও ঢাকার অবস্থান ছিল ১৪০টি দেশের মধ্যে ১৩৭তম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে দুই ধাপ নিচে নেমেছে ঢাকা মহানগরী।
পাঁচটি সূচকের ভরমান যোগ করে পাওয়া সার্বিক রেটিংয়ের মাধ্যমে এ তালিকা তৈরি করেছে ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এর মধ্যে স্থিতিশীলতা এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশ সূচকের ভরমান নেয়া হয়েছে ২৫ শতাংশ করে। ২০ শতাংশ করে নেয়া হয়েছে হেলথকেয়ার ও অবকাঠামোর ভরমান। বাকি ১০ শতাংশ ভরমান নেয়া হয়েছে শিক্ষা সূচক থেকে। এ পাঁচ সূচকের ভরমান যোগ করে ঢাকার সার্বিক রেটিং দাঁড়িয়েছে ১০০-এর মধ্যে ৩৮।
এর মধ্যে স্থিতিশীলতা বা আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে ঢাকা। ছোটখাটো ও সহিংস অপরাধের মাত্রা, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি, সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ও নাগরিক বিক্ষোভ বা সহিংসতার আশঙ্কা বিবেচনায় ‘স্থিতিশীলতা’ সূচকে ঢাকার গত বছরের স্কোরে কোনো পরিবর্তন আসেনি এবার।
এ সূচকে ঢাকার মোট স্কোর দাঁড়িয়েছে ৫০। বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে তলানির দিকে থাকা অন্যান্য নগরীর অবস্থান এদিক থেকে বেশ খারাপ।
বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থাকে তলানিতে ঠেলে দিয়েছে মূলত অবকাঠামোগত দুর্বলতা। সড়ক নেটওয়ার্ক, গণপরিবহন, আবাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা, পানি সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মান বিবেচনায় ঢাকার সার্বিক স্কোর দাঁড়িয়েছে ১০০-তে মাত্র ২৬ দশমিক ৮। এসব সূচকে ঢাকার দৈন্যদশার চিত্র প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। বিশেষ করে নগরীর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দৈন্যদশা এখন চরমে।
তীব্র যানজট এখানকার প্রায় প্রতিটি সড়কের নিত্যদিনের চিত্র। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, এক দশকেরও বেশি সময় আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ছয় কিলোমিটারে। শুধু যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে অপ্রতুল সড়ক, অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
বর্ষা এলেই রাস্তাঘাটে খোঁড়াখুঁড়ি করে দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন সেবা সংস্থা। এর মধ্যে সামান্য বৃষ্টি হলেই নাগরিকদের নাভিশ্বাস তুলে দেয় জলাবদ্ধতা আর যানজট। অপ্রশস্ত রাস্তাঘাটের ভাঙাচোরা দশা মেরামতেও দেখা যায় মারাত্মক ঔদাসীন্য। ঢাকার যানজট নিরসন করতে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়।
এসব উদ্যোগকে ‘বাস্তবসম্মত’ নয়, বরং ‘প্রকল্পসর্বস্ব’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সড়কে প্রাণহানি ও অঙ্গহানির ঘটনাও ইদানীং বেশ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। রাজধানীমুখী বিপুল জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এখানকার অপ্রতুল আবাসন ব্যবস্থাও। এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ নানা সেবা সরবরাহ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে এন্তার।
যেসব সূচক ঢাকাকে বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে তলানিতে ঠেলে দিয়েছে, তার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবাও অন্যতম। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা এবং মান, ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা এবং সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা সূচকের মান বিবেচনায় ঢাকার সার্বিক স্কোর দাঁড়িয়েছে ১০০তে ২৯ দশমিক ২। ঢাকা নিয়ে নাগরিকদের অভিযোগ রয়েছে যথেষ্ট।
সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নেই। নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক যন্ত্রপাতিও। চিকিৎসকের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার কার্যক্রম বন্ধ রাখার নজিরও রয়েছে কোনো কোনো হাসপাতালে। দেশে নাগরিকদের স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। অতিরিক্ত ফি আদায়সহ অর্থ গ্রহণে নানা ধরনের অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধেও।
উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে ঢাকার সংস্কৃতি ও পরিবেশ সূচকেও। গত বছরের ৪৩ দশমিক ৩ থেকে এবার সূচকটিতে ঢাকার স্কোর নেমে এসেছে ৪০ দশমিক ৫-এ। সূচকটিতে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো— আর্দ্রতা বা উষ্ণতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, খেলাধুলার সুযোগ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, খাদ্য ও পানীয় এবং ভোক্তাপণ্য ও সেবা।
অতিমাত্রায় দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে। চলতি মৌসুমেই এ উত্তাপ ভালোভাবেই টের পেয়েছে নগরবাসী। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা বায়ুমান সূচকেও বেশ দুরবস্থায় রয়েছে ঢাকাবাসী।
এছাড়া শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য ঢাকা নগরী খুব একটা আদর্শ স্থান নয়। এখানকার অধিকাংশ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। শিশুর চলাচলের উপযোগী নয় এ শহরের পথঘাট। পার্ক থাকলেও তা ক্ষমতাবানদের দখলে। অথবা পার্কে এমন কিছু তৈরি করা হয়, যা শিশুদের খেলার উপযোগী নয়। শিশুদের জন্য নেই নিরাপদ গণপরিবহনও। এর ওপর রয়েছে সর্বব্যাপী দূষণ, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করছে।
শিশুস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শহরের শব্দ, বায়ু ও পানিদূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণের কারণে কানে কম শোনা, ক্ষুধামান্দ্য, স্থায়ী মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এর মধ্যে শব্দ ও বায়ুদূষণ শিশুস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। বাতাসে বিষাক্ত সিসা, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করায় শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
শিক্ষা সূচকে ঢাকার স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। গত বছরের মতো এবারো মোট ৪১ দশমিক ৭ পয়েন্ট অর্জন করেছে ঢাকা। বেসরকারি ও সরকারি খাতে শিক্ষার মান, পর্যাপ্ততা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সূচকটির মান নিরূপণ করা হয়েছে।
Posted ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৫ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta