কক্সবাংলা ডটকম(২৬ মে) :: সাপ অন্যতম এক আতঙ্কের নাম। পুরো বিশ্বে সাপের কামড়ে দৈনিক দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা, ভুল চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবসহ নানা কারণে এ ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ সমস্যাকে সবচেয়ে বড় অপ্রকাশিত বা উপেক্ষতি স্বাস্থ্য সঙ্কট হিসেবে অ্যাখায়িত করেছে।
থাইল্যান্ডের দমকল কর্মী পিনো পকপিনো। বুড়ো আঙ্গুলে কিং কোবরা কামড় দেয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে পৌঁছে যান। হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সিরাম দেয়া হয়। দ্রুত সিরাম প্রয়োগ না করলে শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে যা আক্রান্ত ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেয়।সৌভাগ্যক্রমেই সে যাত্রায় বেঁচে যান পিনো।
পিনো বলেন, ডাক্তাররা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে আমাকে একটি কিং কোবরা কামড় দিয়েছে। তখন আমি তাদের বলেছিলাম, সাপ চেনানোর কর্মশালায় আমি একজন প্রশিক্ষক। আমি বিভিন্ন ধরনের সাপ খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, কিং কোবরা কামড় দেয়ার পর প্রায় দুইমাস আমি ভুগেছি। আঙ্গুল থেকে মরা টিস্যু অপসারণ করতে আরো দুইবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
তবে পিনোর মতো খুব অল্প সংখ্যক রোগীই হাসপাতাল থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেন। কারণ বেশিরভাগেরই পিনোর মতো সাপ বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই। এসব রোগীর ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসা তাদের জীবনে চূড়ান্ত পরিণতি ডেকে আনে।
প্রতিবছর সাপের কামড়ে ৮১ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ব বরণ করছে আরো চার লাখ। সাপের কামড়ে চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভেনমের ঘাটতিই এই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা ও দুর্গমতার কারণে সাব-সাহারা আফ্রিকা ও এশিয়ার গ্রামীণ অঞ্চলে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
লন্ডনভিত্তিক দাতব্য জীববিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ক সংস্থা ওয়েলকাম ট্রাস্টের দেয়া তথ্যানুযায়ী, যেকোনো অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগের চেয়ে সাপের কামড়ে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা বেশি। অধ্যাপক মাইক টার্নার বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক অ্যান্টি-ভেনম পাওয়া গেলে এ ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা কমার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বেশিরভাগ সময়ই বিষধর সাপ কামড়ের পর আর কিছুই করার থাকে না, ফলে অবধারিতভাবে মৃত্যু হয়।
ওয়েলকাম ট্রাস্টের এ পর্যালোচনার সঙ্গে একমত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও)। গত বৃহস্পতিবার সংস্থাটির পক্ষ থেকে সাপের কামড়ে মৃত্যুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লুক্কায়িত স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ওপর জোর গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি। ২০৩০ সালের মধ্যে সাপের কামড়ে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ডব্লিউএইচও। লক্ষ্য পূরণে সাপের কামড় প্রতিরোধে জনসাধারণকে প্রশিক্ষণ দেয়া, চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো কার্যকর করে তোলা এবং স্বাস্থ্য-সেবা আরো উন্নত করার কার্যক্রম গ্রহণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর এসব কার্যক্রমে ১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে সংস্থাটি।
ওয়েলকাম ট্রাস্টও এ ধরনের কার্যক্রমের পেছনে ব্যয়ের অঙ্ক বিপুল পরিমাণে বাড়িয়েছে। আগামি সাত বছরে ১০ কোটি ১৩ লাখ ডলার ব্যয় করবে সংস্থাটি। যেখানে গত দশকে তিন কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয় করেছিলো ওয়েলকাম ট্রাস্ট।
অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরো কার্যকর অ্যান্টি-ভেনম তৈরি করতে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় বর্তমান পদ্ধতিটি খুব বেশি আধুনিক নয়। এছাড়া এই পদ্ধতিটি পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্তও নয়। অন্যান্য ওষুধ বাজারে নিয়ে আসার আগে যেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় অ্যান্টি-ভেনমকে সে আওতায় ফেলা হয় না।
খুব বেশি মুনাফা না হওয়ায় ফার্মাসিটিকাল কোম্পানিগুলোও অ্যান্টি-ভেনম নিয়ে কাজ করতে চায় না। ২০১০ সালে ফরাসি কোম্পানি স্যানোফি প্যাস্টোর এফএভি-আফ্রিক অ্যান্টি-ভেনমের উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত করে। এই অ্যান্টি-ভেনমটি আফ্রিকায় জন্য কার্যকর হতো।
ওয়েলকাম ট্রাস্টের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে এই মুহুর্তে প্রয়োজনের অর্ধেক অ্যান্টি-ভেনম রয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় অ্যান্টি-ভেনম পাওয়া গেলেও তা খুব বেশি কার্যকর নয়। আফ্রিকা অঞ্চলে এই সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট। এখানকার ৯০ শতাংশ অ্যান্টি-ভেনমই অকার্যকর। এ কারণে অ্যান্টি-ভেনমের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তারা সাপের ছোবলে আক্রান্ত রোগিকে সারিয়ে তুলতে হাসপাতালের পরিবর্তে স্থানীয় ওঝার শরণাপন্ন হয়।
অবশ্য অ্যান্টি ভেনমের উচ্চমূল্যের কারণে এটি দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। এক শিশি অ্যান্টি ভেনমের দাম ১৬০ ডলার এবং পুরোপুরি একটি কোর্স শেষ করতে হলে কয়েক বোতল ওষুধ প্রয়োজন হয়। দরিদ্র ব্যক্তিদের হাতে এতো টাকা না থাকায় এ চিকিৎসার ব্যয়ভার নির্বাহে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের ছোবলে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের ৪০ শতাংশই চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ঋণ নিয়েছেন। একপর্যায়ে এই ঋণ শোধ করতে তাদের সম্পদও বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
ডব্লিউএইচওর কন্ট্রোল অব নেগলেক্টেড ট্রপিকাল ডিজিজ বিভাগের ডা. বার্নাদেত আবেলা-রাইডার বলেন, যদি আপনার উপার্জন চিকিৎসা, পরিবহন ও পুর্নবাসনের পেছনেই ব্যয় হয়ে যায়, তাহলে অন্য কিছু একটা হারাতে হবে। এটি হতে পারে সন্তানের শিক্ষা অথবা পরিবারের খাবার।
এ অবস্থায় উন্নত মানের অ্যান্টি-ভেনম তৈরি করতে স্বাস্থ্য-সেবা খাত, প্রতিরোধ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ডব্লিউএইচও।
Posted ৮:১১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৬ মে ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta