কক্সবাংলা ডটকম(১১ মে) :: মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক ভূকম্পন হয়েছে। সে দেশে ছয় দশক ধরে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে (ইউএমএনও) হারিয়ে গতকাল নির্বাচনে জিতেছে নতুন জোট পাকাতান হারাপান (অ্যালায়েন্স অব হোপ— পিএইচ)। রাজনৈতিক এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউএমএনওর একসময়ের প্রাণপুরুষ মাহাথির মোহাম্মদ। বরাবরের সরকারি দলটির আকস্মিক ভরাডুবিতে হকচকিত মালয়েশিয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ গতকাল নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।
তীব্র নাটকীয়তা আর টানটান উত্তেজনায় শেষ হয়েছে মালয়েশিয়ায় সাধারণ নির্বাচন। গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক ভোটারকে অপেক্ষমাণ রেখেই ভোটগ্রহণের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। এরপর ভোট গণনায় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে হারিয়ে তার একসময়ের গুরু ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদের দারুণ প্রত্যাবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের ২২২টি আসনের মধ্যে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত ১৯৬টির ভোট গণনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭ আসনে জিতেছে মাহাথিরের নবীন জোট। ইউএমএনওর নেতৃত্বাধীন জোট বারিসান ন্যাশনাল (ন্যাশনাল ফ্রন্ট— বিএন) জিতেছে ৭৩ আসনে।
এছাড়া ডানপন্থী মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি (পিএএস) ১৬ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটি আসনে জিতেছে। সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যেকোনো দল বা জোটকে কমপক্ষে ১১২ আসনে জিততে হবে।
স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১টা পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে কোনো পক্ষ প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেনি বলে মালয়েশিয়ার নির্বাচন কমিশন এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফলাফল ঘোষণা বিলম্বিত করছে বলে অভিযোগ করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ।
রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা ১১২ আসনের সীমা ছুঁয়েছি। ক্ষমতাসীন জোটের ইশারায় কমিশন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফলাফল ঘোষণা বিলম্বিত করছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত করে জানাচ্ছি যে, আমাদের ১১২ আসন হয়েছে। এ তথ্য মিথ্যা হলে আপনারা আমার নামে মামলা করতে পারেন।
এর আগে রাত ১১টায় ইউএমএনওর প্রধান কার্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত হননি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। পরে দলের এক ঘোষণায় আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ওই ব্রিফিং স্থগিত করা হয়েছে বলে জানানো হয়। ক্ষমতাসীন দলের নীরবতা, নির্বাচন কমিশনের কালক্ষেপণ আর বিরোধী দলের দাবি— সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শহরে গতকাল ছিল অনিশ্চয়তার রাত। দ্রুত ফলাফল ঘোষণার দাবিতে সরকারবিরোধীরা কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ করে।
মালয়েশিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের পাশাপাশি ১২টি রাজ্যের আইনসভার ৫০৫ জন সদস্য নির্বাচনেও গতকাল ভোট হয়েছে। রাজ্যগুলোর নির্বাচনেও নাজিব রাজাকের বিপর্যয়ের জোরালো আশঙ্কা দেখা গেছে। ১৩টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিতেই ক্ষমতাসীন বিএন জোট শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নেগরি সেরিম্বান, পাহাং ও তেরেঙ্গানুতে একটি করে আসনে জিতেছে। অন্যদিকে মাহাথিরের জোট জোহর, পেনাং, পেরাক ও সেলাঙ্গোরে যথাক্রমে ৬, ৮, ১৪ ও ৪টি আসন দখল করেছে। বিএনের ফিক্সড ডিপোজিট ভোট বলে অভিহিত সাবাহ প্রদেশে পিএইচ জোট চারটি আসনে জিতেছে।
মালয়েশিয়ায় এটা ১৪তম সাধারণ নির্বাচন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচন অনেক কারণে তাত্পর্যপূর্ণ। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দেয়া মাহাথির মোহাম্মদ অবসর নেয়ার দেড় দশক পর রাজনীতিতে ফিরেছেন তার একসময়ের অনুসারী নাজিব রাজাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে। গুরু-শিষ্যের লড়াইয়ে নবতিপর মাহাথির চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন তারই দীর্ঘদিনের দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে (ইউএমএনও)। ৬৪ বছর বয়সী নাজিব এখন দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নির্বাচনী লড়াইয়ে মাহাথির জিতলে মালয়েশিয়ায় প্রথমবারের মতো ইউএমএনও ছাড়া অন্য দলগুলো সরকার গঠন করবে। রাজনীতিতে মালয় জনগোষ্ঠীর একাধিপত্য ভেঙে চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও প্রভাব অর্জন করবে। একই সঙ্গে প্রমাণ হবে, মালয় জনগোষ্ঠী এবং মালয়েশিয়ার বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কাছে দল ও প্রতীক ছাড়িয়ে মাহাথিরই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
মাহাথিরের দারুণ ফেরার এ নির্বাচন নাজিবের জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। নির্বাচনে জিতলে নাজিব সুযোগ পাবেন নিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও সন্দেহ ঝেড়ে নতুন সূচনার। তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে তিনি ইউএমএনওর ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখবেন। তবে দলের নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে তাকে অবশ্যই বিএন জোটের ভোট বৃদ্ধি প্রমাণ করতে হবে। ২০১৩ সালে নাজিবের নেতৃত্বে বিএন ১৩১ আসনে জিতলেও ভোটসংখ্যায় বড় পতন দেখা যায়।
বাঁচা-মরার লড়াইয়ে প্রচারণার শেষ মুহূর্তেও নাজিব ভোটারদের মনোভাব প্রভাবিত করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে তিনি বিএন জোট জিতলে ২৬ বছর ও তার কম বয়সীদের আজ থেকে আয়কর অব্যাহতি, সোম ও মঙ্গলবার দুটি অতিরিক্ত সরকারি ছুটি এবং জুনে ঈদের ছুটি উপলক্ষে পাঁচদিন সব সড়ক-মহাসড়কে টোলমুক্ত যাতায়াতের সুযোগ মিলবে বলে ঘোষণা দেন।
এবারের নির্বাচনটি মালয়েশিয়ার তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি ইসলামিক পার্টি অব মালয়েশিয়ার (পিএএস) জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পিএইচও বিএন জোটের কোনোটি ১১২ আসনে জিততে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে মালয়েশিয়ায় কিংমেকার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন ডানপন্থী এ দলের নেতা আবদুল হাদি আওয়াং। তেরেঙ্গানু প্রদেশে ক্ষমতাসীন দলটি শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিজ ঘাঁটিতে অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি সাতটি ফেডারেল আসনে জিতেছে।
মালয়েশিয়ার নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হলে দেশটির তরুণ ভোটারদের শক্তি স্পষ্ট হবে। দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগঠিত তরুণরাই মাহাথিরকে অবসর ভেঙে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করেন। ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি এবং নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ তরুণরা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে বারসিহ (স্বচ্ছতা) আন্দোলন গড়ে তোলেন।
নাজিব রাজাক ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সার্বভৌম বিনিয়োগ তহবিল ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ গঠন করেন। ওয়ানএমডিবি নামে পরিচিত তহবিলটির দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়কে না দিয়ে তিনি নিজেই এর উপদেষ্টা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন।
সে সময় বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম অভিযোগ করেন, কোনো নিবন্ধিত বিজনেস অ্যাড্রেস উল্লেখ ও নিরীক্ষক নিয়োগ না করেই রাষ্ট্রীয় এ তহবিল গঠন করেছেন নাজিব। ২০১৪ সাল নাগাদ ওয়ানএমডিবি ঋণগ্রস্ত হতে থাকে। পরের বছর বেরিয়ে আসে ওই তহবিল থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনা।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ওয়ানএমডিবি থেকে ৪৯০ কোটি ডলার আত্মসাৎ হয়। এর মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক ঘুরে নাজিব রাজাকের নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা হয়। একপর্যায়ে নাজিব তার অ্যাকাউন্টে ৭০ কোটি ডলার জমার কথা স্বীকার করেন। তবে ওই অর্থ সৌদি রাজপরিবার তাকে নির্বাচনী তহবিল হিসেবে দেয় বলে তিনি দাবি করেন।
যদিও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রশ্নের উত্তরে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি অবগত নন বলে জানান। অন্তত ছয়টি দেশে এখনো ওয়ানএমডিবি ঘিরে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত চলছে। ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির পাশাপাশি অজনপ্রিয় গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্সও (জিএসটি) নাজিবের ভোট কমিয়েছে। তিন বছর আগে প্রবর্তিত এ করের সমালোচনা করেছে বিরোধী দলগুলো। নির্বাচনী প্রচারণায় মাহাথির জিএসটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি চীনা বিনিয়োগে ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণের ধারা ভাঙবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
Posted ১:০৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta