কক্সবাংলা ডটকম(৯ ফেব্রুয়ারি) :: মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঘটনাটি নিয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবি উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও প্রতিবেদনটি তৈরিকারী মিয়ানমারের কারাগারে থাকা রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ নিয়ে রয়টার্সের অনুসন্ধান প্রকাশের পর স্বাধীন তদন্তের আহ্বান
শুক্রবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স রাখাইনের ইন দিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা ও গণকবরে মাটি চাপা দেওয়ার ঘটনাটির বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করছিলেন মিয়ানমারে গ্রেফতার হওয়া রয়টার্সের দুই সাংবাদিক।
যাদেরকে দেশটির উপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে, কিভাবে দশজন সাধারণ রোহিঙ্গাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বা গুলি করে হত্যা করেছে স্থানীয় বৌদ্ধ ও সেনারা।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী মুখপাত্র হিদান নোয়ার্ট বলেন, গণকবরের আগের খবরগুলোর মতোই এই প্রতিবেদনটি রাখাইনে নিপীড়নের অভিযোগের বিষয়ে স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য তদন্তে বার্মা (মিয়ানমার) কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা করার গুরুত্ব হাজির করেছে।
মুখপাত্র আরও বলেন, এ ধরনের তদন্ত যা ঘটেছে সেটার বিস্তারিত চিত্র পেতে, নিপীড়িতদের শণাক্ত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করতে সহযোগিতা করবে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে স্থানীয় এক বৌদ্ধের স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরা হয়। যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লাশ মাটিচাপা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জড়িত থাকা কোনও ব্যক্তির পক্ষে এধরনের স্বীকারোক্তি এই প্রথম প্রকাশ পেল।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পূর্বে নিধনযজ্ঞের বিষয়ে রয়টার্সের সংগৃহীত প্রমাণের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জাও হতায় বৃহস্পতিবার জানান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়টি আমরা অস্বীকার করছি না।
মুখপাত্র জানান, যদি নিপীড়নের ঘটনায় শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকে তাহলে সরকার তদন্ত করবে।
তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর মিয়ানমার সরকারের কোনও তাৎক্ষণিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি রোজেনা অ্যালিন-খান বিবিসির নিউজনাইট অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত বছর তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন।
রোজেনা বলেন, একটি গণহত্যার সময় আমরা দর্শক ছিলাম। এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, কারণ আগস্টের পর এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ হলো। আর আমরা তা একেবারে নিপীড়কদের কাছ থেকেই শুনছি।
ব্রিটিশ এমপি জানান, আন্তর্জাতিক তদন্তের পাশাপাশি বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মুক্ত মত ও মতপ্রকাশ বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কাইয়ি এক টুইটে বলেন, এই প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করার সময় রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে মিয়ানমার পুলিশ। তাদেরকে এখনও কারাগারে রাখা হয়েছে। অবশ্যই তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী ইয়াংহি লিও ইন দিন নিধনযজ্ঞের স্বতন্ত্র, গ্রহণযোগ্য তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছয় লাখেরও বেশি মানুষ।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ আখ্যা দিয়েছে। রাখাইনের সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
যে অনুসন্ধানের কারণে মিয়ানমারে আটক হয়েছেন দুই রয়টার্স সাংবাদিক
শুক্রবার প্রকাশিত রয়টার্সের এক বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের আলামত মিলেছে। ওয়া লোন ও কিয়াও সো উ যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। ওই দুই সাংবাদিক এখন মিয়ানমার সরকারের হাতে আটক রয়েছেন। রয়টার্স বলছে, বৃহস্পতিবারের প্রকাশিত প্রতিবেদনটিই তাদের আটকের নেপথ্য কারণ।
ওয়া লোন ও কিয়াও সো উ নামে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে ১২ ডিসেম্বর আটক করে মিয়ানমার পুলিশ। এই ঘটনা তুলে ধরার জন্য রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টস-এর অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ প্রমাণ হলে ১৪ বছরের সাজা হতে পারে তাদের। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থাটির দাবি, এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্যই তাদের আটক করেছে মিয়ানমার সরকার।
সেনাবাহিনী জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ১০ রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দিলেও গ্রামবাসীর ওপর ঘটনার দায় চাপানোর চেষ্টা করে। নিহতদের তারা ‘বাঙালি জঙ্গি’ আখ্যা দেয়। সেই ঘটনার অনুসন্ধান চালিয়ে রয়টার্স দেখিয়েছে, ওই ১০ রোহিঙ্গা ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী। ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণসহ খোদ সংশ্লিষ্টদের কাছে থেকে পাওয়া বিবরণের ভিত্তিতে এসব কথা জানায় রয়টার্স। তাদের দাবি, এই প্রতিবেদনের কারণেই তাদের দুই সাংবাদিককে আটক করে রেখেছে মিয়ানমার।
বার্তা সংস্থাটির প্রধান সম্পাদক স্টিফেন জে এডলার বলেন, ‘ওয়া লোন ও কিয়াও সোকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন আমরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। আমরা যখন সেখানের আইনি ব্যবস্থা বুঝতে পারি আমরা তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলি। আমাদের মনে হয় তাদের পরিশ্রমের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব।’
২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ আখ্যা দিয়েছে। রাখাইনের সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।