তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। আঙ্কারার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শাস্তিমূলক’ অর্থনৈতিক উদ্যোগকে তুর্কি-মার্কিন ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এর জের ধরে তুর্কি মুদ্রা লিরার রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। আগামী দিনগুলোয় মুদ্রাটির মান আরো কমলে আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতন ছাপিয়ে স্বর্ণের দাম চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে লিরার বিপরীতে মার্কিন ডলারের ক্রমবর্ধমান বিনিময় হার স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধিতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। খবর কিটকো নিউজ ও রয়টার্স।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধরন, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে আঙ্কারার পরিকল্পনা ও ২০১৬ সালে এরদোগানবিরোধী অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারীদের শাস্তি নিয়ে ন্যাটোর দুই প্রভাবশালী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মনোমালিন্য চলে আসছে। সম্প্রতি ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও গোয়েন্দাগিরিতে’ অভিযুক্ত এক মার্কিন ধর্মযাজকের আটকাদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের বেশ কজন কর্মকর্তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এর পর থেকে মুদ্রাবাজারে তুর্কি লিরার অবস্থান দুর্বল হতে শুরু করে। আঙ্কারার বিরুদ্ধে সর্বশেষ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে তুর্কি ইস্পাত আমদানিতে ৫০ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এ ঘোষণার পরে মুদ্রাবাজারে ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে ধুঁকতে থাকা তুর্কি লিরার রেকর্ড ১৮ শতাংশ পতন হয়। ২০০১ সালের আর্থিক সংকটের পর তুরস্কের ইতিহাসে এটাই লিরার সবচেয়ে বড় দরপতন। সর্বশেষ কার্যদিবসে লিরার দরপতন হয় ২২ শতাংশ। তুর্কি-মার্কিন এ বিরোধকে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। লিরার ক্রমাগত পতন ঠেকাতে এরদোগান তুর্কি নাগরিকদের প্রতি সংগ্রহে থাকা স্বর্ণ ও ডলার বিক্রি করে দেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলমান ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে তুরস্ক জয়ী হবে’ বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
মুদ্রাবাজারে লিরার নড়বড়ে অবস্থানকে স্বর্ণের জন্য ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করেন শিকাগোভিত্তিক ব্লু লাইন ফেউটার্সের প্রেসিডেন্ট বিল বারুচ। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, লিরার রেকর্ড দরপতন মুদ্রাবাজারে সম্ভাব্য অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা মুদ্রাবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। বিপরীতে বিনিয়োগ বাড়বে স্বর্ণে। এর জের ধরে আগামী দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবান ধাতুটির দাম বাড়তে শুরু করবে।
চলতি বছরের এপ্রিলের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দরপতন অব্যাহত রয়েছে। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের স্পটমূল্য ১ হাজার ৩৪০ ডলারের আশপাশে অবস্থান করেছিল। দরপতনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ কার্যদিবসে প্রতি আউন্স স্বর্ণের স্পটমূল্য ১ হাজার ২১৩ ডলার ৩৫ সেন্টে নেমে এসেছে। এখন তুর্কি-মার্কিন অর্থনৈতিক যুদ্ধের জের ধরে লিরার রেকর্ড দরপতনে স্বর্ণের বাজার চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে এক্ষেত্রে ডলারের তুলনামূলক শক্ত অবস্থান সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে বিল বারুচ বলেন, নড়বড়ে লিরা স্বর্ণের দাম বাড়ালেও ডলারের শক্তিশালী অবস্থান এ রাশ টেনে ধরতে পারে।
ফরাসি ব্যাংক বিএনপি পারিবাস, ইতালির ব্যাংক ইউনিক্রেডিট ও স্পেনের ব্যাংক বিবিভিএর এক যৌথ নোটে বলা হয়েছে, তুরস্কের মুদ্রা সংকট পুরো ইউরোপের আর্থিক ব্যবস্থা ও মুদ্রাবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আর এ পরিস্থিতি স্বর্ণের বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, যা মূল্যবান ধাতুটির দাম বাড়িয়ে দেবে।
নিউইয়র্কভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্রাউন ব্রাদার্স হ্যারিম্যান অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু ক্যানিংহাম বলেন, তুরস্কে চলমান মুদ্রা সংকট দেশটির আর্থিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে এর ঢেউ ইউরোপের দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনটা হলে আগামী দিনগুলোয় মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। আর মুদ্রাবাজার অস্থির হলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলক নিরাপদ বিবেচনা করে স্বর্ণের প্রতি ঝুঁকবেন। চাহিদা ও বিনিয়োগ বেড়ে গেলে মূল্যবান ধাতুটির দামও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।