কালাম আজাদ(২৬ মার্চ) :: ১৯৭১সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারির শহিদ এটিএম জাফর আলম ( মুক্তিযোদ্ধার আইডি নং- ০২০৬০৫০০৪১, গেজেট নং ৩৩১)। পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ জাফর আলম। পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের রুমখাঁপালং গ্রামের ছৈয়দ হোসাইন মাস্টারের সন্তান তিনি।
১৯৪৭ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণকারী এটিএম জাফর আলম ১৯৬৪ সালে মহেশখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্টিক, ১৯৬৬ থেকে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৭০ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে ১ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। অনার্স পাশের পর, সোহরাওয়ার্দী কলেজে খণ্ডকালিন অধ্যাপক হিসেবে মহান শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন এবং কলেজ শাখার দপ্তর সম্পাদক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন একনিষ্ট কর্মী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে তিনি ইকবাল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হল) হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ওই হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে হল বার্ষিকী ‘কষ্টিপাথর’ সম্পাদনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অংশগ্রহণ করেন ৬ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে, ৭০ এর নির্বাচনে রামু-উখিয়া-টেকনাফে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন।
তৎকালিন পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সিএসপি) পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে এসডিও হন। ২৪ মার্চ ১৯৭১ নোয়াখালী জেলায় যোগদান পত্র গ্রহণ করার পরে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রাক্কালে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাক হানাদারেরা নিরস্ত্র বাঙালির উপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাত্তরের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ইকবাল হল তথা জহুরুল হক হল থেকে। (বস্তুত ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকে ওই ছাত্রাবাসটি ছিল স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সদর দপ্তর বিশেষ।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায়কে নস্যাৎ করার জন্য ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একাত্তরের মার্চ মাসে ধাপে ধাপে তা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় বঙ্গবন্ধু এক রাতে জ-রুল হক হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে এক অঘোষিত সভায় মিলিত হন বলে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ নামক বইতে উল্লেখ করেন।
পাকিস্তান বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জহরুল হক হল। সৌভাগ্যবশত ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগে প্রায় সব ছাত্রনেতা ও কর্মী হল ছেড়ে চলে যান। কক্সবাজারের কৃতি সন্তান আবু তাহের মোহাম্মদ জাফর আলমও ২৫ মার্চ রাতে চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ডাক তাকে আসতে বাঁধা দেয়।
সেদিন রাত থেকে ২৬ মার্চ সারাদিন ওই হলে নীলক্ষেত রোড থেকে মার্টার, রকেট, লষ্ণার রিকলেস রাইফেলস এবং ভারী মেশিন গান ও ট্যাংক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালিত হয়। এ সময় এটিএম জাফর আলম অন্যান্য স্বাধীনতাকামী ছাত্রনেতাদের নিয়ে ইকবাল হলে অবস্থান করেছিলেন। সেদিন রাইফেল দিয়ে হানাদার বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পাক বাহিনীর হামলায় ইকবাল হলে শহীদ হন। , জাফরকে তিন তলা থেকে টেনে হিচড়ে নামাতে নামাতে মেরেছে। নিচতলায় এসে জাফরের মাথা ফেটে যায়। এবং তার মগজ বেরিয়ে সিড়ির সাথে লেগে থাকে। ’
তারই সাথে উক্ত হলের মেধাবী ছাত্র, ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় সংসদের সহ-সভাপতি সাংবাদিক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান, সালেহ আহমদ মজুমদার, জাহাঙ্গীর মনির, আবুল কালাম, মো. আশরাফ আলী খান, আবু তাহের পাঠান এবং শামসুদ্দিন ও আবদুল জলিল নামের ২ কর্মচারীসহ নাম না জানা আরো অনেকেই নির্মমভাবে খুন হয়। আজও এটিএম জাফর আলমসহ ৭জনের নাম সার্জেন্ট জহরুল হলের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে এম মুনিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৭১-৭২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে শুধু ইকবাল হলে (আজকের জহুরুল হক হল)-ই প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হয় বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রতিবেদনে শহীদ জাফরের কোনো কথার উল্লেখ নাই।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এটিএম জাফর আলম চৌধুরীর একান্ত বন্ধু চলচ্চিত্র অভিনেতা সোহেল রানা তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির শহীদ বলে বিভিন্ন টক শো, সাক্ষাৎকার এবং লেখায় উল্লেখ করেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা, ১৯৭১-৭২ সনের ইকবাল হল ছাত্র সংসদের ভিপি মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় ‘সে রাতে জাফর ও চিশতীকে হারালাম’ নামক এক স্মৃতিকথায় বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল। বর্তমানের সার্জেন্ট জহরুল হক হল,। ২১৬ নম্বর রুমের আবাসিক ছাত্র ছিলাম আমি। মার্চের ২৫ তারিখ রাত সাড়ে ১০ টায় দেখা হলো জাফরের সঙ্গে। ইকবাল হল ছাত্রসংসদের নেতা। স্বাধীনতার প্রচণ্ড সমর্থক। মিছিল মিটিং সাংগঠনিক কাজে তার অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। তবে রাজনীতির উগ্রতা বা হিংসা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলতো। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল ঠান্ডা মেজাজের ছেলে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে রাজনৈতিক তীব্রতা বাড়তে থাকলে জাফর আলম দেশে চলে যায়। তার গ্রামের বাড়ি সূদুর উখিয়ায়। মার্চের ১০ তারিখ হলের করিডোরে দেখি জাফর আলম। বলে, পারভেজ ভাই- আমি কিছুই সহ্য করতে পারছি না। যুদ্ধ করবো, গ্রামে থাকা কি যে অসহ্যকর- তোমরা সবাই ঢাকায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইকবাল হলে ট্রাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করে আর জাফর আলম সরাসরি স্পট ডেড হয়। জাফরের কথা মনে হলে আজো মন কেমন করে। হলে থাকার কথা আমার-ওতো বেরিয়েই গিয়েছিল কিন্তু হলো উল্টো। হলে থেকে গেলো জাফর-আমি চলে এলাম বাইরে।’
চোখের সামনে ভেসে উঠলো জাফরের নির্মম দৃশ্য শিরোনামের আরেকটি লেখায় বিশিষ্ট্য নায়ক সোহেল রানা হলের দায়োয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন, জাফরকে তিন তলা থেকে টেনে হিচড়ে নামাতে নামাতে মেরেছে। নিচতলায় এসে জাফরের মাথা ফেটে যায়। এবং তার মগজ বেরিয়ে সিড়ির সাথে লেগে থাকে। ’
সোহেল রানা বললেন, দেশশত্রু মুক্ত হলে যখন ইকবাল হলে যাই, দেখলাম সেই মগজ শুকিয়ে গেছে। ’
শহীদ অধ্যাপক এটিএম জাফর আলম বিবাহে বাগদত্তা ছিলেন বলে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ ও ড. রীটা আশরাফ লিখিত ‘স্বাধীনতা আনল যারা’ নামক বই এবং কালাম আজাদ লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার : জানা অজানা তথ্য-নামক গবেষণায় উল্লেখ আছে। এছাড়া এ অঞ্চলের আরেক কৃতিসন্তান কবি সিরাজুল হক সিরাজ শহীদ এটিএম জাফর আলম ও তার মা নিয়ে করুণ কাহিনি নিয়ে ‘শহীদ জাফরের মা’ নামে একটি হৃদয় বিদারক কবিতা লিখেছেন। যেটি দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপানো হয়েছে।
২০১২ সালের ৫ মে দীর্ঘ ৪১ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শহীদ এটিএম জাফর আলমের ছোট ভাই, তৎকালিন রাষ্টপ্রতি কার্যালয়ের সচিব (বর্তমানে মন্ত্রী পরিষদ সচিব) মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে জাফর আলমের বিএসসি অনার্স (১৯৬৯) ও এমএসসি (১৯৭০) পরীক্ষার সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এটিএম জাফর আলম চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদক ( মরণোত্তর)- ২০১৯ প্রদান করেছে বাংলাদেশ সরকার ।
শহীদ জাফর আলম’র স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে রুমখাপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘শহীদ এটিএম জাফর মিলনায়তন’, মাহমুদুল হক চৌধুরী উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে রেজু খালের সড়কটিকে শহীদ জাফর আলম চৌধুরী সড়ক এবং গত জোট সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক ও রেলপথ বিভাগ সজস-৩ শাখা প্রজ্ঞাপন তারিখ ৫ জানুয়ারি ২০০৯ নং সওরে/সজস-৩/১এম-৮০/ ৯৭-১৩ কক্সবাজার লিংকরোড তেকে টেকনাফ পর্যন্ত (৭৯.০০ কি. মি) আরাকান সড়কের নাম পরিবর্তন করে শহিদ এটিএম জাফর আলম আরাকান সড়ক হিসেবে নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ গেজেট, ৮ জানুয়ারি ২০০৯-এ অন্তর্ভূক্ত আছে এটিএম জাফর আলম আরাকান সড়কের নাম। কক্সবাজার- টেকনাফ আরাকান সড়কটি এখন শহীদ এটিএম জাফর আলম সড়ক।
এ লেখাটি আমার মুক্তিসংগ্রামে কক্সবাজার নামক গবেষণা কর্মের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যায়ের একটি অংশ। এতে তথ্যগত কোনো ভুল থাকলে জানানোর অনুরোধ রইল।
কালাম আজাদ : কবি ও সাংবাদিক। সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ : রাজাকারনামা এই ছবিটি আমি ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের গ্রন্থাকার থেকে সংগ্রহ করেছিলাম
সূত্র : ফেইস বুক
Posted ১১:২২ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta