বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ।
সোমবার (১৩ জুন) কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে এসব বর্ণনা উঠে আসে। ২৯ জনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
এর মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে জেলা কারাগারে এবং প্রথম গুলি চালানো রহিমসহ ১৪ জন ঘটনার পর থেকে পলাতক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই রোহিঙ্গা শিবিরে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে জড়িত বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
দাখিল করা অভিযোগপত্রে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে আরসা নেতা ও রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ছলিমকে। তিনি উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের নুর বশরের ছেলে।
এরপর যথাক্রমে আছে একই ক্যাম্পের শওকত উল্লাহ, মোহাম্মদ সালাম, জিয়াউর রহমান, মো. ইলিয়াছ, মো. আজিজুল হক, মোর্শেদ প্রকাশ মুর্শিদ, নুর মোহাম্মদ, আনাস, নজিম উদ্দিন, আবুল কালাম প্রকাশ আবু, হামিদ হোসেন, সিরাজুল মোস্তফা ওরফে সিরাজুল্লাহ ওরফে সিরাজ, মৌলভি মো. জকোরিয়া, খাইরুল আমিন, মাস্টার আবদুর রহিম ওরফে রকিম, জাহিদ হোসেন ওরফে লালু, ফয়েজ উল্লাহ, ছমির উদ্দিন ওরফে ছমি উদ্দিন ওরফে নুর কামাল, সালেহ আহমদ, মোজাম্মেল ওরফে লাল বদিয়া, তোফাইল, মাস্টার শফি আলম, আবদুস সালাম ওরফে জাকের মুরব্বি, জকির, হাফেজ আয়াছ, মাস্টার কাশিম, মাস্টার শুক্কুর আলম ও মোস্তফা কামাল।
এছাড়া নাম-ঠিকানা শনাক্ত না হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে হামলার ঘটনায় নির্দেশদাতা আরসাপ্রধান জুনুনি, ওস্তাদ খালেদ ওরফে খালিদ, ওস্তাদ হাশিম, ইব্রাহিম, আলমগীর, শুভ ওরফে আলমগীর ও মৌলভি মোস্তাকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
যদিও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কয়েকজন ঘটনার সঙ্গে জুনুনিসহ সাতজনের সম্পৃক্ত থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২৯ সেপ্টেম্বর মাগরিবের নামাজের পর ফারুক মাঝির ব্লকে মার্কাজের মোড়ে সালামত উল্লাহর দোকানের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হাজিন হন।
সেখান থেকে মাস্টার আবদুর রহিম, ছমির উদ্দিন ওরফে নুর কামাল, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে লাল বদিয়ার নেতৃত্বে খাইরুল আমিন, ফয়েজ উল্লাহ, জাহিদ হোসেন ওরফে লুলু ও আজিজুল হক দেশীয় পিস্তল নিয়ে মুহিবুল্লাহর অফিস কক্ষে যান।
আসামি শুক্কুর আলম ও মাস্টার শফি আলম পিস্তল নিয়ে মুহিবুল্লাহর অফিসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। মুহিবুল্লাহ অফিসে ছিলেন না। তাকে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ শেষে মুহিবুল্লাহ তার নিজের ঘরে ছিলেন। এ সময় মোরশেদ ওরফে মুর্শিদ বসতঘরে গিয়ে মুহিবুল্লাহকে ডেকে অফিসে নিয়ে আসেন। একটু পর আরসা নেতা মাস্টার আবদুর রহিম, আবদুস সালাম, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে লাল বদিয়া, খাইরুল আমিন, জাহিদ হোসেন ওরফে লালুসহ অন্যরা তার অফিসে যান।
আরসা নেতা মাস্টার আবদুর রহিম প্রথমে মুহিবুল্লাহর নাম ধরে বলেন, ‘আমরা তোকে নিয়ে যেতে এসেছি, তুই ওঠ। ’ কথা শুনে মুহিবুল্লাহ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাস্টার আবদুর রহিম নিজের হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে মুহিবুল্লাহর বুকের ডান পাশে একটি গুলি করেন।
এরপর জাহিদ হোসেন ওরফে লালু মুহিবুল্লাহর বুকের ডান পাশে ও নাভির ওপর পরপর আরও দুটি গুলি করেন। চতুর্থ গুলিটি করেন খাইরুল আমিন। গুলিটি ডান কাঁধে বিদ্ধ হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় মুহিবুল্লাহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি চালিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে আত্মগোপন করেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মুহিবুল্লাহ।
এর কিছুদিন পর ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’ পালনের লক্ষ্যে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দুই লাখ রোহিঙ্গার সমাগম ঘটেছিল। মুহিবুল্লাহর ডাকে রোহিঙ্গারা সেখানে সমবেত হয়েছিল।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার প্রধান নেতা জুনুনি কিছুতেই মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং ভবিষ্যতে আরসার কর্মকাণ্ডের জন্য মুহিবুল্লাহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন- এ ভাবনা থেকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
সোমবার পুলিশ ২৯ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে জেলা কারাগারে বন্দি। প্রথম গুলি চালানো রহিমসহ ১৪ জন ঘটনার পর থেকে পলাতক।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও সংগঠনিটির চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পরেই মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ডে আরসা জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছিল।এ ঘটনার দীর্ঘ তদন্ত শেষে সোমবার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজী সালাহ উদ্দিন।
Posted ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৪ জুন ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta