রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ও অন্যান্য স্মৃতি

বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৯
305 ভিউ
কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ও অন্যান্য স্মৃতি

কক্সবাংলা ডটকম(২৩ অক্টোবর) ::

‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ
দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।’
(অভিশাপ দিচ্ছি কবিতার অংশ বিশেষ)

বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে যে কয়জন কবি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে কবিতা লিখেছেন তাদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান অন্যতম। তার লেখনীর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গতিশীল হয়েছে; লেখনীতে ফুটে উঠেছে একজন কবির সামাজিক দায়। তার লেখা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তার কবিতা ‘আসাদের শার্’সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামও তিনি কবিতায় ঋদ্ধ করে রেখেছেন। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, শামসুর রাহমান বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তাকে কবিশ্রেষ্ঠ বলা হতো। দুই বাংলায় তার জনপ্রিয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব সমান্তরাল ধারায় প্রতিষ্ঠিত। কবি শামসুর রাহমানকে প্রথম দেখেছিলাম অনেক আগে একবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করার সময়। কবির পরিধেয় বস্ত্র ছিল ঝলমলে। মানে ওই বয়সেও তিনি ছাপার শার্ট পরতেন, ডান হাতে বাঁধতেন ঘড়ি। আমৃত্যু তাকে এভাবেই দেখেছি। তার আত্মজীবনী ‘কালের ধূলোয় লেখা’ বইটিসহ আরো চারটি বই সম্পাদনা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন তার গভীর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। প্রতিদিন তার বাসায় যেতাম, খেতাম আড্ডা দিতাম। প্রাণ খুলে কথা বলতাম কবির সঙ্গে। তার  ব্যবহারে মনে হতো তিনি এক আশ্চর্য দেবশিশু। অতি সাধারণ লাজুক ভঙ্গিতে বলতেন, ‘ভাই কাল রাতে একটা লিখে রেখেছি, তোমাকে না দেখিয়ে কাউকে দেইনি। তুমি একটু দেখে দাও। ভাই, দেখ, ভালো না লাগলে সত্যি করে বোলো কিন্তু। খারাপ হলে খারাপ বোলো। আমি একটুও কষ্ট পাবো না, রাগও হবো না। কবিতাটা তো ভালো হওয়া চাই।’

তারপর যখন কবিতাটা পাঠ করে বলতাম, ‘রাহমান ভাই, চমৎকার কবিতা!’ তখনও তিনি দেবশিশুর মতো হাসতে হাসতে বলতেন, ‘সত্যি বলছো তো ভাই? দেখ আমি কিন্তু তোমাকে খুব বিশ্বাস করি।’
রাহমান ভাইয়ের এই শিশুসুলভ আচরণের মধ্যে কোনো ভনিতা ছিল না। তিনি কখনো কারো ওপর রাগ করেছেন, এমনও আমি দেখিনি। রাহমান ভাইয়ের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কীভাবে লেখা হলো এ কথা আমি তার কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে যখন পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালাতে শুরু করে মানুষ তখন হতভম্ব হয়ে যায়। রাহমান ভাইদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সবাই ধীরে ধীরে একত্রিত হয়। তারপর তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওখানে রাহমান ভাই নিজেকে খুব অসহায় মনে করতেন। একদিকে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে বর্বর বাহিনী, তারা পাহাড়ে, নগরে, গ্রামে সবখানে খুনের রাজত্ব কায়েম করছে, হেমন্তের পাকা ধানের মতো লাশ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে, সারা দেশে চলছে গণহত্যা। এর মধ্যে গড়ে উঠছে প্রতিরোধ যুদ্ধ। রাহমান ভাই তার বাড়ির পাশের গাছ তলায় দাঁড়িয়ে দেখতেন কৃষাণ-শ্রমিক-মুটে-মজদুর সবাই প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। তিনি নিজেকে খুব অসহায় মনে করতেন। কারণ তিনি সম্মুখযুদ্ধে যেমন অংশগ্রহণ করতে পারছিলেন না, আবার মেনে নিতেও পারছিলেন না এই অসহায়ত্ব। এমন এক মানসিক অবস্থায় তাদের ঘরের পাশে একটা গাছতলায়, যেখান দিয়ে মানুষজনের হাঁটাচলা দেখা যায়, দেখা যায় এক মাল্লাই নৌকায় পারাপার হচ্ছে মানুষ, ধানক্ষেত আরো কত কী; ওই গাছতলায় বসেই তিনি লিখে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধের অমর কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’।

এরপর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটা কীভাবে লেখা হয়েছিল। রাহমান ভাই বললেন, তখন তিনি ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সভা করছে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শোভাযাত্রা বের করছে। সে সময় কয়েক হাজার পুলিশ, ইপিআর ছাত্রদের মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সাহসী তরুণেরা প্রত্যেকেই কমবেশি আহত অবস্থায় বন্দি হয়েছিল। ২০ জানুয়ারি ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা পদদলিত করে অকুতোভয়ে পুলিশ-ইপিআরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সেদিন জনতার মারমুখো প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল তারা; অকেজো হয়ে যায় শাসকের কাঁদানো গ্যাস। সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে বেরিয়ে যায় বিরাট শোভাযাত্রা শহীদ মিনারের দিকে, শহীদ মিনার হয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে। সেই শোভাযাত্রায় গুলি চালানো হয়। আমি বাসায় বসেই শুনলাম একটি মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে। সেই মিছিলের অন্যতম নায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান মেডিকেল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তারপর জনতা আসাদের লাশ ছিনিয়ে মুখোমুখি লড়ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত জনতা আসাদের শার্ট ছিনিয়ে নেয়। আমি যখন গুলিস্তান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন দেখছিলাম ছাত্র-জনতা মিলে একটা লাঠির সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা শার্ট ঝুলিয়ে মিছিল করছে। দৃশ্যটি আমাকে ভীষণ আহত করেছিল। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। অফিসে গিয়েও আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। বারান্দা দিয়ে কী এক উদ্বিগ্নতা নিয়ে বারবার হাঁটছিলাম। তারপর এক সময় কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। লিখলাম ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।

রাহমান ভাই বারবার বলতেন, ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে। কিন্তু এটা আমার জন্য এক সময় বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ালো। রাহমান ভাইয়ের কোনো কবিতা সুন্দর করে পড়লেই তার চোখ জলে ভিজে যেত। তিনি বলতেন, ‘ভাই আমি মরে গেলে এই কবিতার কথা কি কেউ মনে রাখবে?’
আমি বলতাম, ‘রাহমান ভাই, বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে ততদিন কবি শামসুর রাহমানের কবিতা টিকে থাকবে।’
রাহমান ভাই আশ্বস্ত হতেন। এর কয়েক দিন পরে, ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতাটি শামসুর রাহমানকে উৎসর্গ করা ছিল। কবিতাটি ছিল এমন :

‘আমরা কেউ মধুমতি, যমুনা
কারো কারো পায়রা ও বিষখালী নাম
চর্যাপদের বাড়ি পাড়াতলী গ্রাম।’

রাহমান চর্যাপদ হিসেবে নিজেকেই ভেবেছিলেন এবং তার সেদিনের খুশির মাত্রা ও ভাষা বর্ণনাতীত।

হঠাৎ করে একদিন তিনি বললেন, ‘দীপংকর, আমার বাড়িতে (পুরান ঢাকার আশেক লেনের গলি) যেতে খুব ইচ্ছে করে। ওই গলিটার ভেতরে বসে আমরা চা খাব।’
তার ছেলের বউ টিয়া রাহমান কবির কথায় রাজি হলেন না। মূলত তিনিই তাকে দেখাশোনা করতেন। ফলে ওবার আর যাওয়া হলো না। পরে আমরা একবার আশেক লেনের গলিতে গিয়েছিলাম। সেখানে রাহমান ভাইকে সবাই ‘বাচ্চু মিয়া’ বলে ডাকে। রাহমান ভাইয়ের ডাক নাম ওটাই ছিল। ওখানে ‘বাচ্চু’ নামে আরেকজন ছিলেন যিনি কবির শৈশবের বন্ধু। তিনি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘দোস্ত চা কিল্যাই? তুমি আইছো, কুবলাই বিরানি রান্না অইবো। এ্যালায় চা-ফা ওই ছব বাদ।’
কিন্তু রাহমান ভাইয়ের খাবার সীমিত এবং নিয়ম করা। কুবলাই বিরিয়ানি খাওয়া হলো না। সেদিন কবিকে পেয়ে ওই লেনের লোকজন উৎসবে মেতে উঠেছিল। কিন্তু এক সময় আমাদের ফিরতেই হলো। গাড়িতে আসতে আসতে রাহমান ভাই বললেন, ‘এখানে আসলে আমি শিশু হয়ে যাই।’

রাহমান ভাইকে নিয়ে এমন অজস্র স্মৃতি, অজস্র কথা এখনো আমার কানে বাজে। রাহমান ভাই একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তার প্রথম ভালোবাসার গল্প। আরো অনেক কথা বলেছিলেন, কিন্তু শর্ত ছিল তার জীবদ্দশায় কাউকে বলা যাবে না।
তার কিছুদিন পর শুনলাম রাহমান ভাই ভীষণ অসুস্থ। বাসায় গেলাম। রাহমান ভাই শুধু ফিরে তাকালেন। মনে হলো অনেক কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু সেসব আর কখনওই তার বলা হয়ে ওঠে নি। হঠাৎ করেই একদিন তিনি চলে গেলেন অমৃতলোকে। রাহমান ভাইয়ের প্রয়াণের পর কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ‘যুগান্তর’ থেকে একটা এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন তাকে নিয়ে স্টোরি করার। সেই স্টোরি আমি
করেছিলাম। স্টোরির বিষয়বস্তু ছিল, রাহমান ভাইয়ের সেই কক্ষটি, যেখানে বসে তিনি কথা বলতেন, আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন, লিখতেন- সেই ঘরের বিবরণ। স্টোরিটার নাম ছিল ‘কবিশূন্য কবিতা ঘর’।
বহুদিন রাহমান ভাইয়ের বাসায় যাওয়া হয় না। কিছুদিন আগে তার ছেলে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এখন আব্বু নেই, আমরা তো আছি। আব্বু যাদের পছন্দ করতেন তারা যদি না আসে, আমরা ভীষণ কষ্ট পাই।’
ভাবি, যাব। কিন্তু যাওয়া হয় না। যাই যাই করে দিন চলে যায়।

লেখক- দীপংকর গৌতম  : সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক।

305 ভিউ

Posted ৪:৩৬ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com