কক্সবাংলা ডটকম(১৪ মার্চ) :: স্টিফেন হকিং ছিলেন আধুনিক যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের শীর্ষে। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। বাবা চেয়েছিলেন হকিং বড় হয়ে চিকিৎসক হোক। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হকিংয়ের আগ্রহ বিজ্ঞানে আর গণিতে।
পরে হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেন।
জীবনের প্রথমার্ধে অর্থাৎ ২১ বছর বয়সেই দুরারোগ্য মটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন হকিং। কিন্তু হকিংয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা কখনোই থেমে ছিল না। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ‘বিগ ব্যাং থিউরি’র প্রবক্তা স্টিফেন হকিং। হকিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক পদ থেকে ২০০৯ সালে অবসর নেন।
শারীরিক অক্ষমতা হকিংকে কখনোই রুদ্ধ করতে পারেনি। ১৯৮৮ সালে ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন হকিং। কারণ বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হিসেবেও খেতাব পায় বইটি।
পদার্থ বিজ্ঞানে হকিং এতটাই পারঙ্গমতা লাভ করেছিলেন যে, আইনস্টাইনের পরই তাকে দ্বিতীয় বিখ্যাত পদার্থবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদকসহ এক ডজনেরও বেশি ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি।
যে কারণে বিখ্যাত স্টিফেন হকিং
হকিংয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং বোর-হাইজেনবার্গের কোয়ান্টামতত্ত্বকে মিলিয়ে দেওয়া। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কাজ করে মহাজগতের অতিকায় বস্তু নিয়ে আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের বাহাদুরি হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে। হকিং কৃষ্ণবিবরের ঘটনা দিগন্তের ঠিক বাইরে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের প্রয়োগ করলেন। অনিশ্চয়তা তত্ত্ব আবার কোনো শূন্যস্থানে বিশ্বাস করে না। ফলে মহাশূন্যের কোনোটাই শূন্য নয়। সেখানে সব সময় কণা-প্রতিকণার সৃষ্টি হচ্ছে আর পরমুহূর্তে নিজেরা মারামারি করে বিলীন হচ্ছে।
হকিং দেখালেন, ঘটনাদিগন্তে কৃষ্ণবিবরের আকর্ষণে এ রকম জোড়া কণার কোনো কোনোটি আটকা পড়ে যেতে পারে। তখন তার সঙ্গী জোড়াটি আর বিমূর্ত থাকে না অর্থাৎ সে মূর্ত হয়ে ওঠে। আর এই মূর্ত হওয়ার ভরটি সে কৃষ্ণবিবর থেকে সংগ্রহ করে নেয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কৃষ্ণবিবর আর কৃষ্ণ থাকছে না। অনবরত সেখান থেকে বের হয়ে আসছে কণা স্রোত। হকিংয়ের নামানুসারে এই কণাস্রোতের নাম দেওয়া হয়েছে হকিং বিকিরণ।
শারীরিকভাবে অচল হয়েও তিনি সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘হুইল চেয়ারের বিজ্ঞানী’। পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। এমায়োট্রুফিক ল্যাটারাল স্কেরোসিসে (এক প্রকার মটর নিউরন রোগ) আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হয়েও বহু বছর ধরে তিনি গবেষণাকর্ম চালিয়ে গেছেন। আজ বুধবার ৭৬ বছর বয়সে জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে পারি জমালেন পরপারে। আসুন জেনে নিই তার জীবনের কিছু টুকিটাকি
জন্ম
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম অক্সফোর্ডে। যা গ্যালিলিও এর জন্মের ঠিক ৩০০ তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। তার বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক। মা ইসাবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী।
ছাত্র ভাল ছিলেন না
১৯৫০ সালে হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবাতে চলে যান। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং সেন্ট অ্যালবার মেয়েদের স্কুলে পড়েন। সে সময় দশ বছর পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো। অনেক বিখ্যাত জনের মতো স্টিফেনও স্কুলে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু ছোট বেলাথেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল। এজন্য শিক্ষক ও বন্ধুরা আদর করে ডাকতেন আইনস্টাইন।
অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ
বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে চিকিৎসক বানাবেন নয়তো অক্সফোর্ডে পড়াবেন। কিন্তু অর্থ সঙ্কটে সেই স্বপ্ন ভেঙেই যাচ্ছিল। পরে স্টিফেন হকিং অংশ নেন স্কলারশিপ পরীক্ষায়, টিকেও যান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৯ সালে তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানে সম্মান কোর্সে ভর্তি হন।
ছিলেন রেসিং বোট টিমের সদস্য
আত্মজীবনী লেখক ক্রিস্টিন লার্সেন এর ভাষ্যমতে স্টিফেন হকিং ভার্সিটি জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন অনেক বেশি নিঃসঙ্গ। তাই হয়তো একাকীত্ব দূর করতেই যোগ দিয়েছিলেন কলেজের বোট রেসিং টিমে। সবচেয়ে মজার কথাটি হল তার দায়িত্ব ছিল রেসের সময় নৌকার হাল ধরে রাখা এবং এই কাজটি তিনি এতো সফলতার সাথে করেছিলেন যে অল্পকিছুদিনেই হয়ে উঠেছিলেন পুরো অক্সর্ফোডে বিপুল জনপ্রিয়। সপ্তাহে ছয়দিন সন্ধ্যায় প্র্যাকটিস করতে হতো বোট চালানোর। যা তার পড়ালেখায় মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। পরে অবশ্য তার নিরলস পরিশ্রমে সব পাল্টে যায়। তিনি সাফল্যের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
ক্যামব্রিজ, সাফল্য ও হতাশা
অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ১৯৬২ সালে স্টিফেন হকিং পা রাখেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি গবেষণার জন্য বেছে নেন মহাবিশ্বতত্ত্ব। মহাবিশ্বতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য স্টিফেনকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের চর্চা করতে হতো। গণিতের ভিতটা মজবুত না হওয়ায় তাকে বিভিন্নভাবে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।
ঠিক এই সময় স্টিফেনের দুরারোগ্য স্নায়ুবিক অসুখটি ধরা পড়ল যার নাম মটর নিউরন ডিজিজ। ডাক্তাররা স্টিফেনের মেয়াদ বেঁধে দিলেন দু’বছর। দুঃখ-ভরাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত স্টিফেন জীবনের প্রায় সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনের রয়েল সোসাইটির এক সভায় ফ্রেড ওয়েলের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে পারায় বিজ্ঞানীরা তার উচ্চ প্রসংশা করেন। একজন তরুণ গবেষক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পান। স্কিয়ামার অধীনে পিএইচডিতে কর্মরত অবস্থায়ই মহাবিশ্ব সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে হকিং সুনাম অর্জন করেছিলেন।
এরপর লন্ডনের এক সভা থেকে হকিংয়ের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কিংস কলেজের সেই সভায় রোজার পেনরোজ তার বক্তৃতায় কৃষ্ণ বিবরের কেন্দ্রে স্থান-কাল অনন্যতার ধারণা সম্পর্কে অবহিত করেন। পেনরোজের এই ‘অনন্যতার-ধারণা’ হকিংয়ের পিএইচডি লাভের পথ সুগম করে। অবশেষে তেইশ বছর বয়সে স্টিফেন হকিং নামের আগে ডক্টর লেখার অধিকার অর্জন করেন।
প্রেম ও বিয়ে
গ্রাজুয়েশন শেষ করে এক অনুষ্ঠানে দেখা হয় জেন উইলডের সাথে। তার একুশ সপ্তাহ পরই তার রোগ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। তারপর লিউকেমিয়ায় মরনাপন্ন এক শিশুকে দেখে তিনি ফিরে পান বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাছাড়া জেনের উপস্থিতিও স্টিফেনকে আবার নতুন করে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করছিল। তাই জেনকে নিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুলাই স্টিফেন ও জেনের বিয়ে হয়। এ দম্পতি দুটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তানের জনক-জননী হন।
জেন ও হকিংয়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বরে হকিং তার নার্স মেসনকে বিয়ে করেন। দশ বছর সংসারের পর ২০০৬-এ হকিং ও মেসনের ছাড়াছাড়ি হয় এবং স্টিফেনের সঙ্গে জেনের সম্পর্ক আবার গভীরতর হয়।
তার লেখা প্রথম বই ও বেস্ট সেলার
শারীরিক অবস্থার অবনতির সঙ্গে সঙ্গে হকিংয়ের বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হতে থাকে। তিনি তার সব গবেষণালব্ধ ধারণা লিপিবদ্ধ করেন, ‘এ ব্রিফ স্টোরি অফ টাইম’ নামক গ্রন্থে। এ বইটি প্রায় এক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে এবং সব বেশি বেশি বিক্রীত বইয়ের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এ বইটি পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হিসেবেও খেতাব পায় বইটি।
১৯৯৩ সালে হকিং ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেইস’ নামক বইটি লিখেছেন। যেখানে তিনি তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরেন। ১৯৯৬ সালে তিনি স্যার রজার পেনরোজকে সঙ্গে নিয়ে ‘দ্যা নেচার অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’ নামের বইটি লিখেন। তার পরবর্তী বছরে তারা দুজন আরেকটি বই লিখেন যার নাম ‘দ্যা লারজ, দ্যা স্মল অ্যান্ড দ্যা হিউম্যান মাইন্ড’। এভাবে সবক্ষেত্রে, সব পর্যায়ে তিনি ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেন।
লিখেছিলেন ছোটোদের বই
২০০৭ সালে স্টিফেন হকিং তার মেয়ে লুসি হকিং এর সাথে মিলে লিখেছিলেন ছোটোদের বই ‘George’s secret Key to the Universe’ যা জর্জ নামের ছোটো বালকের কাহিনী কিন্তু যাতে রয়েছে ব্ল্যাকহোলসহ নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা। ২০০৯ সালে বের হয়েছে এই বইয়ের পরবর্তী পর্ব।
[youtube https://www.youtube.com/watch?v=2f3WcIvTLYk]
নতুন করে বেঁচে থাকা
যখন বিজ্ঞানী হিসেবে স্টিফেন হকিংয়ের খ্যাতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন ভাগ্য তাকে তেমন পুরস্কৃত করেনি। ত্রিশ বছর বয়স থেকে কেবল মাথা ও হাতের সীমাবদ্ধ নড়াচড়া ছাড়া পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে তিনি হুইল চেয়ারে বন্দি হলেন। তিনি শুধু কম্পিউটারের কণ্ঠ সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে কথা বলতে পারেন যা তার সংবাদকে শব্দে পরিণত করতে পারে। কিন্তু এরকম ভয়াবহ শারীরিক অক্ষমতা তাকে দমাতে পারেনি। কম্পিউটার ব্যবহার করে গবেষণার কাজ চালানো এবং বক্তৃতা প্রদানে তিনি এখনও এক অবিশ্রান্ত কর্মী। তার শারীরিক সমৃদ্ধির জন্য একটি আমেরিকান সংস্থা তাকে চব্বিশ ঘণ্টার সেবা সুবিধা প্রদান করছে।
জীবনাবসান
অবশেষে আজ বুধবার (১৪ এপ্রিল) বর্তমান বিশ্বের সবচে বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী ৭৬ বছর বয়সে পরপারে চলে গেলেন।
Posted ১২:৩৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৪ মার্চ ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta