কক্সবাংলা ডটকম(৪ সেপ্টেম্বর) :: বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্য ড. কারমেন জেড লামাঙ্গা। পাশাপাশি তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি চেয়ারম্যান মিজ নাদিয়া আনোয়ার। তিনি স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন।
ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ ড. হাসানুল এ হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স, প্রশাসনসহ আরও দুটি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি আছেন মোট ৫টি দায়িত্বে। বিওটির অপর সদস্য ইশতিয়াক আবেদীন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জনসংযোগ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
শুধু এআইইউবিই নয়, নতুন প্রতিষ্ঠিত মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির সদস্যরা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কেউ ভিসি আবার কেউ প্রোভিসি।
অর্থের হিসাব দেখভালের বিশেষ পদ ‘কোষাধ্যক্ষ’ও দখল করে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। অন্য পদে দায়িত্ব পালনের নামে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। পাশাপাশি কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অথচ ট্রাস্ট আইনে লাভজনক কোনো পদে থাকতে পারবেন না তারা। কিন্তু সেই আইন অহরহ লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এর ফলে ‘অলাভজনক’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লাভজনক’ পদ দখল করে দায়িত্ব পালনের নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় কর প্রদানের ইস্যুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু বিওটি সদস্য বা তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাভজনক পদ অলঙ্কৃত করছেন। এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু এই বেআইনি কাজ করা যাবে না। সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।
ইউজিসির অফিস আদেশে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের লক্ষ্যে ২০১১ সালের জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা জারি করে বলেছে যে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিওটির কোনো সদস্যের নাম তিনজনের প্যানেলে প্রস্তাব করা যাবে না।
এমতাবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগের লক্ষ্যে ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নন প্রতিটি পদের বিপরীতে এমন ৩ জন ব্যক্তির নামের প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে।
ওই আদেশে আরও বলা হয়, বিওটির কোনো সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লিখিত ৩ পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। একইসঙ্গে ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী বিওটির কোনো সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না।
তবে অভিযোগ আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিওটি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ভিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটির মালিক ড. আবুল হাসান মো. সাদেক তাদের একজন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত ভিসি নেই। এনপিআই ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন বিওটি সদস্যরা। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারের তিনটি পদই পরিবারের সদস্যদের দখলে। এরকম আরও বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন বলেন, আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ ও অভিযোগ আছে যে, বিওটি সদস্যরা শুধু ভিসি-প্রোভিসির মতো উল্লিখিত তিন পদে বসছেনই না, তারা মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন তারা। কেউ কেউ একাধিক পদ দখল করে একাধিক পদে ৫-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে কেনা বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ অহরহ। এসব সমীচীন নয়। এ কারণে উল্লিখিত আদেশ জারি করা হয়েছে।
ইউজিসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ট্রাস্ট আইনে লাভজনক পদ দখলের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও লাভজনক পদে গেলে বিওটি থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, সর্বনিম্ন ৯ জন ও সর্বোচ্চ ২১ জন সদস্য নিয়ে বিওটি গঠন করতে হবে। কিন্তু এমনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার ৯ সদস্যই বাবা-মা ও ভাইবোন নিয়ে। কিন্তু উল্লিখিত ৯ জনের মধ্য থেকে যদি ৩ বা ৪ জন পদত্যাগ করেন তাহলে আর ট্রাস্টি বোর্ড থাকে না। এ কারণে একসঙ্গে সব পদই দখলের প্রবণতা দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আইন অনুযায়ী প্রতিবছর আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে নিশ্চয়ই বিওটি সদস্যদের অর্থ গ্রহণের তথ্য থাকে। কিন্তু সেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হয় দেখেন না, নতুবা চেপে যান।
ওইসব কর্মকর্তা আরও বলেন, আইনের একটি ধারার সুযোগ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় অধিশাখার শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। এসব সদস্য বিভিন্ন মিটিংয়ে সিটিং অ্যালাউন্সের সম্মানীর নামে মোটা অঙ্কের অর্থ নিচ্ছেন। ফলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অপকর্ম না দেখার ভান করছেন। এ ব্যাপারে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের নজর দেয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিওটির যেসব সদস্য ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষের পদ দখল করে আছেন তাদের বেশির ভাগ আইন অনুযায়ী অযোগ্য। ভিসি পদে নিয়োগ পেতে পিএইচডি ডিগ্রিসহ ১০ বছরের অধ্যাপনা ও ২০ বছরের প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা লাগবে। প্রোভিসি পদে নিয়োগ পেতে পিএইচডি ডিগ্রিসহ ১০ বছরের অধ্যাপনা এবং ১৫ বছরের প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা লাগবে।
কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে ১৫ বছরের অধ্যাপনা, প্রশাসনিক বা আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা লাগবে। কিন্তু দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি এমন ব্যক্তিদের উল্লিখিত পদগুলোতে বসানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনে না থাকলেও ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে বসিয়ে বছরের পর বছর পার করা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করতে বললে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাবি করা হয় যে, উপযুক্ত অধ্যাপক পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমার কাছে চাইলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ জন অধ্যাপক দিতে পারব। আসলে বেতন-ভাতা দিতে অনাগ্রহ ও বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কব্জায় রাখার মানসিকতা থেকে এমন করা হচ্ছে। কিন্তু আইন না মানলে আমরা কাউকে সহযোগিতা করতে পারব না
Posted ৩:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta