আমিনুর রহমান সুলতান(৫ অক্টোবর) :: জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সৃজনশীল কাব্যজগতের পাশাপাশি মননশীল সাহিত্য জগতেও পরিচিতি রয়েছে। কবিতা ও গদ্যের সমান মানস নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে আলোচিত এবং খ্যাত। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মুজিব মৌলিক’। তার এ গ্রন্থে মুজিব মৌলিক সত্তার আবিষ্কার ঘটেছে। যে মৌলিক সত্তা নিয়ে গভীর আলোচনার এখন খুবই অভাব। সেই সত্তার মধ্যে আছে মুজিবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও চেতনার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। এই গ্রন্থে দার্শনিকভাবে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার জায়গাটিকে ধরতে চেয়েছেন লেখক।
ভৌগোলিক পরিবেশ এবং লোকমানুষের ভাবসম্পদ কখনো কখনো সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তা পূর্ববঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে যা হওয়ার মতো ঘটনা ছিল না। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের চাইতে পূর্ববঙ্গের জীবনযাপনে মাতৃভাষার স্বরূপ ও জাতিসত্তা আবিষ্কারের আগ্রহ ছিল অধিক।
বঙ্গবন্ধু পূর্ববঙ্গের এই ধারাটিকে ১৯৪৭ সালের আগস্টের পর থেকেই আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চিন্তক বঙ্গবন্ধুর সাফল্যের সূচনা এখান থেকেই। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বোধে এও ছিল যে, পূর্ববঙ্গ মুসলিম প্রধান অঞ্চল হলেও অধিকাংশ মুসলমানই ছিল বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান হলেও জাতিগত দিক থেকে বাঙালি পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান।সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি আবার বাঙালি মর্যাদাবান জাতি ভাষার প্রশ্নে ভাষার প্রভাব বাঙালি জাতিকে করেছে গৌরবময়।
এই গৌরব বাঙালিকে মহিমান্বিত করেছে, ঐক্যে দাঁড় করিয়েছে। বাঙালি জাতির ঐক্য গড়ে তুলবার মর্মমূলে ছিল বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। সেটি কখনো কখনো থেমে গেছে; অকালমৃত্যু হয়েছে। কখনো বা বাধাগ্রস্ত হলে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে এসেছেন, বাঙালির ঐক্য সাধনে ও বন্ধনে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, স্বার্থান্ধ বা মোহগ্রস্থতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। জেলজীবন দীর্ঘ হলেও সংগ্রামের ধাপগুলো অতিক্রম করেছেন রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে।
লেখকের মূল্যায়ন ‘মুজিব মৌলিক’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করছি- ‘বলা বাহুল্য, ভাষা আন্দোলন, একুশ দফা, এগারো দফা, ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণবিস্ফোরণ, তৎপরবর্তী গণভোট, গণতান্ত্রিক বিজয়, স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব থেকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ও আদর্শবাদী নেতৃত্বই বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সর্বাপেক্ষা নির্ণায়ক সত্য।
এই দীর্ঘ পথযাত্রার যে কোনো পর্যায়ে তার আদর্শ-চ্যুতি বা স্বার্থান্বেষী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুদূরপরাহত করে রাখতে পারত। এই একটি কারণেই তিনি অনন্য ও বিকল্পরহিত। আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গাথা। তাই বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ, বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু। এই উচ্চারণে কাব্যিক আতিশয্য থাকতে পারে, কিন্তু অসত্য নেই।’
এই ধারাবাহিকতা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছিল। স্বতঃস্ফূর্ততার যে ধারাবাহিকতা তা নিজের মধ্যেই পরম্পরা সৃষ্টি করে দিয়েছিল। নতুন দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হওয়ার মতো কাজ তার আগে কোনো সমাজসংস্কারক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রতিভাত হয়নি। বঙ্গবন্ধুই ব্যতিক্রম। জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ভাষায় বলা যায়- ‘একালের প্রাগ্রসর সমাজ যতখানি বিদ্যায়তনিক গ্রন্থনির্ভর ও পাঠনির্ভর, ঠিক ততখানি স্বজ্ঞাপ্রসূত বোধনির্ভর কিনা প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে আধুনিক সমাজে মৌলিক মানুষের দেখা সহজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় পাঠ, পূর্ব-জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র ভাষ্যমিশ্রণের মাধ্যমে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত নিরীক্ষক, গবেষক বা পণ্ডিত।
বিংশ শতাব্দীর তেমন এক তুমুল জ্ঞানবীক্ষণ ও বিদ্যামিশ্রণের যুগে স্বজ্ঞা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক মৌলিক মানুষের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে ব্যক্তিবাঙালি তথা গণবাঙালির আদল ও এ যুগের বিশ্ব বাঙালির মনোদৈহিক অবয়ব বিবর্তনের বিচারে তাকে এক স্বজ্ঞাধর, মৌলিক ও স্বেচ্ছাচেতন সত্তা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। তার অচিন্ত্যপূর্ব ব্যতিক্রমী উপলব্ধি আর তার বাস্তবায়নের কারণেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি এক বিকল্পবিহীন স্থপতি সত্তায় উন্নীত হয়ে আছেন’ [প্রবন্ধ : মুজিব মৌলিক]।
মুহম্মদ নূরুল হুদার এই যে তিনটি স্তর বিভাজন এবং একত্রিত রূপে চিন্তক ও মৌলিক বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার- এ বিশ্লেষণেও রয়েছে মৌলিকত্ব। শুধু তাই নয়, ‘মুজিব মৌলিক’ গ্রন্থের অন্যান্য লেখাগুলো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষিত। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিকাশের ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভূমিকা ও অবদানের ক্ষেত্রে তারও উৎসমুখ-মৌলিক চিন্তক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মুহম্মদ নূরুল হুদার লেখা ১২টি প্রবন্ধ নিয়ে ‘মুজিব মৌলিক’ গ্রন্থ। অবশ্য ‘যোজনাংশ : কবিতা’য় রয়েছে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক তিনটি কবিতাও।
লেখাগুলো হচ্ছে ‘মুজিব মৌলিক’, ‘নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উক্তি ও উপলব্ধির অভিব্যক্তি’, ‘নজরুলের ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মানবিক মূল্যবোধ’, ‘আমার দেখা নয়াচীন : বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের উৎসসূত্র’, ‘জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ ও তার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা : জয় ও বিস্ময়’, ‘পনেরোই আগস্ট : শোক থেকে শক্তি’, ‘বাঙালির সব শিশু তোমার রাসেল’, ‘শেখ হাসিনার মানবিকতা,
নান্দনিকতা ও শান্তিসাধনা’, ‘সংশপ্তক শেখ হাসিনা’, ‘স্বাধিকার থেকে সাংবিধানিক নান্দনিকতা’।
যোজনাংশ : কবিতাগুলো হচ্ছে ‘মুজিব মানবিক’, ‘তুমিই শিশু তুমিই পিতা’, ‘অনন্ত মুজিব জন্ম’।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সম্ভবের ক্ষেত্রে কৌতূহল ও অনুসন্ধান বঙ্গবন্ধুবিষয়ক অনেক গবেষকেরই রয়েছে। তবে মুহম্মদ নূরুল হুদার উপলব্ধি ‘মুজিব মৌলিক’ রূপে। এ জন্য তিনি ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করেছেন।
ব্যক্তি থেকে জাতিতে মুক্তির বীজ বোনা, মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত ও জাগ্রত করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। মাধ্যম রাজনীতি। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুটি ছিল মানবিক। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষও তাকে ভালোবেসেছে অকৃত্রিম। লোকজীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয় ঘটানোর কাজটি বঙ্গবন্ধুই করেছেন। এ জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক ধারার প্রথম মৌলিক মানবিক হিসেবে অভিহিত করতে পারি। পথটি ধরিয়ে দিয়েছেন, চিহ্নিত করেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা তার ‘মুজিব মৌলিক’ প্রবন্ধগ্রন্থে। পাশাপাশি সত্তার বিভাজন এবং এর যে ক্রমধাপ সেগুলো ‘জনগণতান্ত্রিক’ মন্ত্রে বঙ্গবন্ধুই পরিণত করেছেন।
বাঙালি জাতির বঞ্ছনা, দুঃখ, কষ্ট ঘোচাবার জন্য রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা পায়, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রভৃতি। রাজনীতি রাজনৈতিক অধিকারের পথটি প্রশস্ত করেছে। সোচ্চার হয়েছে রাজনৈতিক অধিকার লাভের ক্ষেত্রে। আবার বাঙালি কবিদের জাতিভাবনা সাহিত্য জগতেও উত্থিত হয়েছে কিন্তু তা একসময় ছিল ভারতের ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রাসঙ্গিকতায়। যেখানে দেশাত্ববোধ অবশ্য স্পষ্ট।
ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধারায় উল্লেখযোগ্য। ব্যতিক্রম বিশ শতকের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রথমে মুসলিম শব্দটি যুক্ত থাকলেও অচিরে অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে দল থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে। এই দলের চাওয়া বা আন্দোলন শুধু বঞ্ছনা, কষ্ট থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার জন্য গণ্ডিবদ্ধ হয়ে থাকা নয়; তার চাইতেও অধিক।
এই দলটি বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের সময়কাল পার করে ষাটের দশকে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তার বিস্তৃত রাজনৈতিক কর্মপরিধির সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক দলটিও।
রাজনৈতিক অধিকারের স্থানে জায়গা করে নেয় রাজনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম। প্রায় ২৪ বছর পাকিস্তানি নয়া ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নিজেকে মুক্তিকামী বাঙালির কণ্ঠস্বর করে তোলেন। জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তার যে মৌলিক ভূমিকা লেখক তারও মূল্যায়ন করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। লেখকের ভাষায় বলা যায়, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় বাঙালি থমকে দাঁড়িয়েছিল অবশ্যই। কিন্তু তার সেই ক্ষণিক স্তব্ধতা পরাজয়ের স্থবিরতায় পর্যবসিত হয়নি, এই সত্যও আজ ইতিহাসেরই ধ্রæব সাক্ষ্য। শোককে শক্তিতে পরিণত করে পরমুহূর্তেই তার করণীয় শনাক্ত করেছে অজেয়গণ বাঙালি’ [প্রবন্ধ : পনেরোই আগস্ট শোক থেকে শক্তি]।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উক্তি ও উপলব্ধির অভিব্যক্তি’। বাংলাদেশ নামটি সম্পর্কে নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর চেতনাগত ঐক্যকে লেখক গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণীয় করে তুলেছেন।
এছাড়া সংস্কৃতির প্রশ্নে নজরুল যে বাংলার ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের কবি ছিলেন আর মধূসূদন, রবিঠাকুর ‘আদিপর্বের বাংলা ঐতিহ্যকে নবায়ন করেছেন’, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন লেখক।
বঙ্গবন্ধু পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী ছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই বর্ণিত হচ্ছে নজরুল-বর্ণিত ‘আত্মশক্তি’র কথা, যাকে নজরুল ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার মূল মন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরোধিতা করেছেন।’
একই সঙ্গে এটি নজরুল-গবেষণাতেও নতুন সংযোজন। প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় ‘নজরুলের জয় বাংলা’। এখানে নজরুল বাহিত ‘জয় বাংলা’ নজরুলের স্বাধীনচিন্তার জাগরণ এবং ‘বাংলা ও বাঙালির জয়ের বোধকে ধারণ করেছে। বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণকে প্রামাণ্য শব্দমন্ত্র হিসেবে গণমুখী করে তুললেন রাজনৈতিক ভিত্তি থেকে।
‘জয় বাংলা’ কী করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবে নতুন মাত্রা লাভ করেছে এবং কবির কল্পনা কী করে বাস্তবের ভিত্তি থেকে রাষ্ট্রভিত্তি লাভ করেছে, তার পর্যালোচনা রয়েছে। শুধু পর্যালোচনাই নয় লেখক কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে তার নিজের কবিতায় বাংলার বিদ্রোহী সত্তা ও বিজয়ী চেতনার ধারাবাহিকতার আলোকে নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’র আত্মিক শক্তি, সামর্থ্যকে নতুন যুগে নতুন করে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থের গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু এ বই নিয়ে আলোচনা খুবই কম হয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও
‘কারাগারের রোজনামচা’-এ দুটি বই নিয়ে আলোচনা অধিক হয়েছে। হয়তো চীনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রকৌশলগত কোনো ভীতি আমাদের বঙ্গবন্ধু-গবেষকদের ভেতরে কাজ করেছে। কিন্তু লেখক এই বইয়ে খুঁজে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের উৎসমুখ।
শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের, পরম্পরার এবং উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে নিয়ে সম্পূরক ৩টি লেখা স্থান পেয়েছে। লেখাগুলো হচ্ছে- ‘শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা : জয় ও বিস্ময়’, ‘শেখ হাসিনার মানবিকতা, নান্দনিকতা ও শান্তিসাধনা’, ‘সংশপ্তক শেখ হাসিনা’।
লেখক শুধু আবেগগতভাবে পিতা ও কন্যার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেননি বরং ইতিহাসের এক পরিক্রমাকে তার প্রবন্ধত্রয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ইতিহাস-নদীর অনিবার্য উৎসবিন্দু এবং চূড়ান্ত স্রোতধারার নাম শেখ হাসিনা।
বাংলার সব গণমানুষকে গণযোদ্ধায় পরিণত করে সেই আশির শুরু থেকে তার যে সামষ্টিক যুক্তিযুদ্ধ ও নৈয়ায়িক গণযুদ্ধ, তারই পরিণতি একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শুরুতেই তথাকথিত ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিধা থেকে অব্যাহতি। অতঃপর ২০২১ সালের মধ্যেই তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু, কোভিডের মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও তৃতীয় বিশ্বের কাছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল ও সারা পৃথিবীর কাছে প্রবৃদ্ধির ‘বিস্ময়’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
এর মূলে রয়েছে বীর বাঙালির আপসহীনতা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ও মানবিকতার অঙ্গীকার, যার সফল উত্তরসূরি ও প্রায়োগিক রূপকার শান্তিকন্যা শেখ হাসিনা। তাই বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা একবিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে এক অবিশ্বাস্য জয় ও বিস্ময় হয়ে আবির্ভূত। এই জয় সাহসিকতার, মাঙ্গলিকতার, জাতিসত্তার ও বৈশ্বিক মানবিকতার।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন দার্শনিক রূপ লাভ করেছে। এমন অনেক আত্মকথন আছে যে অংশ বিশেষের ভেতর মানবিক মূল্যবোধের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। লেখক বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনের বিশেষ এমন একটি অংশ তুলে ধরেছেন যেখানে ‘প্রতিফলিত হয়েছে তার জন্মসূত্র, ভাষাসূত্র, বর্ণসূত্র ও মানবসূত্র’ [প্রবন্ধ : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মানবিক মূল্যবোধ]।
বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনের অংশটি এখানে উদ্ধৃতি করছি, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে” [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী]।শুধু বাঙালি জাতিই নয়, সমগ্র জাতির জন্যই ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাবনা। আর এই ভাবনা অগ্রসর হয়েছে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।
লেখক মানববোধ আর মানবিকবোধ- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে বঙ্গবন্ধুর মানবিক বোধের ধ্যানজ্ঞানকে মূল্যবান করে বিশ্লেষণ করেছেন।
অবশ্য ‘মানবিক মূল্যবোধের উদ্গম ও বিকাশের’ জন্য যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের প্রয়োজন হয়- এ সম্পর্কে লেখক বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।
রাজনৈতিক শক্তি ব্যক্তি জীবনকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই। এই শক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি ছিল স্বচ্ছ। আমরা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম-আন্দোলনের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তিতে তিনি ‘গণবাঙালি’কে সঙ্গে করে মানবিক ও গঠনমূলক মূল্যবোধে অগ্রসর করেছেন তিল তিল করে।
জাতিরাষ্ট্র কাঠামোতে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়। লেখকের উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য, ‘বঙ্গবন্ধুর মানবিক মূল্যবোধের সমন্বিত প্রতিফলন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণীত ও গৃহীত এই দলিলে বঙ্গবন্ধুর জীবনযুদ্ধ ও জীবনদর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে ছত্রে ছত্রে। এটি তার ব্যক্তিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ফসল’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মানবিক মূল্যবোধ]।তার মানবিকতাই তাকে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, জাতির ঐক্য সাধন এবং সাম্যের মূল্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
‘স্বাধিকার থেকে সাংবিধানিক নান্দনিকতা’ মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘সংবিধান নন্দন’ নিয়ে অভিনব লেখা। রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবের ‘সংবিধান নন্দন’ বুঝতে হলে আমি মনে করি আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এই প্রবন্ধটির কাছে আসতেই হবে।
‘বাঙালির সব শিশু তোমার রাসেল’ এই প্রবন্ধেও শুধু ১৫ আগস্টের আবেগি মূল্যায়ন নয়, বরং রাসেলকে প্রেক্ষাপটে রেখে বাঙালির সব শিশুর নান্দনিক সত্তাকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক। যাদের ভেতর রাসেলের স্বপ্ন বাংলাদেশ হয়ে প্রোথিত রয়েছে- ‘বাঙালি যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের আরেকটা রূপ ছিল। সেটা গেরিলা যুদ্ধ। রাসেলও খেলাচ্ছলে এক সুচতুর গেরিলা যোদ্ধা।
রাসেলকে যখন সৈন্যরা ধরতে গেছে রাসেল বলছে, ‘না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও’। রাসেলকে তারা মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় পিতা, মাতা, ভ্রাতৃবধূদের মৃতদেহ দেখিয়েছে। দেখাতে দেখাতে তার ভেতরটাকে আগেই ঝাঁঝরা করে ফেলেছে। তারপর সে মায়ের কাছে গেছে।
সেই থেকে রাসেল মায়ের কাছেই আছে চিরনিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। মা মানে দেশ, মা মানে মাটি, মা মানে পৃথিবী, মা মানে জন্মজন্মান্তরের অনন্ত প্রাণসত্তা। রাসেল এই মাটিতে এই বাংলায় চিরকালের জন্য অঙ্কুরিত হয়ে আছে, প্রস্ফুটিত হয়ে আছে, অনন্তজীবিত হয়ে আছে। বাঙালি পিতা বাঙালি পুত্র বাঙালি মাতা বাঙালি কন্যা- আমরা সবাই বাঙালি। এই বাংলাদেশে সব পিতা, সব পুত্র, সব মাতা, সব কন্যা আমরা সবাই বাঙালি। এখানে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক যেন পরস্পর বিনিময়যোগ্য ও সমার্থক।
বঙ্গবন্ধু মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় বাঙালি জাতি এবং বাঙালি ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। অতীতের অন্যান্য নেতার মতো তার মধ্যে ছিল না রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতা, ভ্রান্ত রাজনীতি। নেতৃত্ব ছিল সামসঞ্জ্যপূর্ণ। মানুষের জন্য রাজনীতিকে গুরুত্ব দেয়ায় তার আচরণে বৈপরীত্য জায়গা পায়নি। ব্যক্তিত্বের প্রভাব সমাজের চাইতেও ব্যক্তি তথা জনমানুষকে প্রভাবিত করে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে ঘটেও ছিল তাই। বাঙালি জাতিকে প্রকৃত মর্যাদা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু প্রথমে নিজেকে উপলব্ধি করেছেন তার ব্যক্তির অবস্থান থেকে। সজ্ঞা দ্বারা যা অন্যান্য নেতার মধ্যে সক্রিয় ছিল না। বাস্তবভিত্তিক গুণাবলির অধিকারী হয়েছিলেন প্রথম তিনি সজ্ঞা দ্বারাই। লেখকের ভাষায় বলা যায়, ‘মৌলিক চিন্তক হওয়ার ক্ষেত্রে তার সমন্বিত রূপ ছিল- সজ্ঞা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার।’
আর এ জন্যই তিনি ভ্রান্ত রাজনীতি মাড়িয়ে সুস্থ ও মূল্যবোধের রাজনৈতিক ধারার শীর্ষে থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঞ্চিত, শোষিত বাঙালি জাতির জীবনের মুক্তি এবং মুক্তির পথ ধরে সে জীবনের পরিবর্তনের লক্ষ্যে ডাক দিয়েছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লবের। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের এখানেও রয়েছে নিজস্বতা এবং রাজনৈতিক প্রতিভার অনন্যতা।
ফরিদ আহমদ দুলাল :: কবি নিজে স্বপ্ন রচনা করেন, জাতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান; প্রয়োজনে কখনো স্বপ্ন বুননের কৌশল শেখান। কবি আত্মানুসন্ধানী হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন, কখনো নিজস্ব জনপদকে জানার মন্ত্র শেখান পরিপার্শ্বকে; নিজেকে জানতে গিয়ে কখনো বিশ্বকে জানার ব্রতে মগ্ন হয়ে যান। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে শব্দের বহিরাবরণ খুলে বের করে আনেন নতুন শব্দের সম্ভার। কবি সর্বক্ষণ ঘোরের গহনে নিমজ্জিত থাকেন; আবার ঘোর ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ান। সত্যের মুখোমুখি হয়ে কখনো নিজেকে অতিক্রম করে যেতে চান; নিজেকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো দার্শনিক অথবা ঋষি হয়ে যান; আমরা তো তেমন একজন কবির অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকি। কবির সৃষ্টিতে আমি অনন্তের সম্ভাবনা খুঁজি; যেখানে সম্ভাবনার আলো দেখতে পাই তার পেছনেই ছুটে যাই আলোর পিপাসা মেটাতে। তেমন এক সম্ভাবনার কবি ভেবেই আমি ছুটে চলি জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার পেছনে।
বারবার তার বাখানে গদ্য লিখি, আরো একটি নতুন গদ্য লিখতে বসে ভাবি- একজন কবিকে নিয়ে এতবার লেখার প্রেরণা কোথায় পাই? উত্তর আসে একটাই, তার সৃষ্টিবৈচিত্র্য। হুদা আমার অগ্রজ, আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, আমার সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা; হুদা আমার সাহস, আমার দিশা- বাতিঘর; হুদা আমার মাথার ওপর আশ্রয়বৃক্ষের ছায়া; আমাকে তাই তাকে দেয়া নৈবেদ্য দৃশ্যমান করতেও লিখতে হয়, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। কেন না মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতার এক চলমান আন্দোলনের নাম, আমি যার নিরন্তর কর্মী, আর তিনি আমার নিরঙ্কুশ নেতা। কৃতজ্ঞতাবশতও আমি লিখে যাই মুহম্মদ নূরুল হুদার আখ্যান।
আমি তার ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ থেকে শুরু করে সদ্য প্রকাশিত ‘আমার মাতৃচুম্বনের আদি স্বর’ পর্যন্ত সমস্ত কাব্য পাঠের দায় থেকে লিখে যাই বারবার। কেউ যখন আমায় মুহম্মদ নূরুল হুদাকে নিয়ে নতুন একটি গদ্য লিখতে বলেন, আমি তাকে বলতে পারি না, ‘ভাই, একজন কবিকে নিয়ে আমি আর কত লিখব!’ সমুদ্র থেকে দু’চার ঘড়া জল তুলে নিলে সমুদ্রে কি জলের ঘাটতি হয়? মুহম্মদ নূরুল হুদা সমুদ্রের মতোই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময়। এখানে আমি লিখতে চাই ‘নতুনের আবাহনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা’। সহ¯্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কবিতা লিখে চলেন; তাকে নিয়ে লেখার জন্য নতুন নতুন অনুষঙ্গের জন্ম দিয়ে চলেন। ধরা যাক সাম্প্রতিক সময়ে তার এতটাই ব্যস্ততা, যে কারণে আমি নিজে ভালোবেসে সযতেœ তাকে এড়িয়ে চলি; কিন্তু কবিতা কি একদিনও তার কাছ থেকে দূরে থাকে? না-কি তিনি কখনো কবিতা কাছ থেকে দূরে থাকেন? এই যে কবিতার প্রতি তার এক বিস্ময়কর ঘোর সর্বক্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে; সেই ঘোর-অনুসন্ধিৎসাই বারবার আমাকে টেনে নিয়ে যায় তার কবিতার কাছে। তিনি তার অগ্রজদের নিয়ে গদ্য লেখেন, সতীর্থদের নিয়ে লেখেন, অনুজদের নিয়ে লেখেন; এমনকি শিক্ষানবিস তরুণদের নিয়েও লেখেন।
একবিংশের প্রথম দশকের কবিদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে দেখতে পাই তার আন্তরিকতা- ‘ষাটের অন্যতম কবি ও কাব্যকোবিদ মুহম্মদ নূরুল হুদা অবশ্য সব সময়ই প্রথম দশকের কবিদের সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনি কখনো বলেছেন, ওরা বাংলা কবিতায় নতুন বাঁক তৈরির সামর্থ্য রাখে, বাংলা কবিতায় গদ্যরীতির ব্যবহার নতুন না হলেও এ সময়ের কবিতার গদ্যরীতিতে বাড়তি একটা দ্যোতনার সন্ধান পাওয়া যায়।’ (বাংলাদেশের কবি ও কবিতা \ ফরিদ আহমদ দুলাল) কেবল প্রথম দশকের কবিতা সম্পর্কে নয়; অন্যরা যখন নিজেকে ছাড়া অন্যের কবিতা বা লেখালেখি প্রসঙ্গে নিস্পৃহ, সেখানে মুহম্মদ নূরুল হুদাকে দেখি অন্যেও কবিতার সৌন্দর্য আবিষ্কারে আন্তরিক। আমরা স্মরণ করতে পারি, একসময় তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ হুদা-কথা’ শিরোনামে নিয়মিত এক কলামের একটি গদ্য লিখতেন; সেই গদ্যে তিনি বিভিন্ন দশকের কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে লিখতেন।
ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে দেখেছি কত নবীন কবির কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছেন; কাউকে কখনো ‘না’ বলতে শুনিনি। আমার ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান’ শিরোনামের গ্রন্থটি যখন প্রকাশিত হয়, তিনি সেই প্রন্থের জন্য নাতিদীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন; এখানে তার সে লেখাটি তুলে ধরতে চাই অনুজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত, তার গদ্যভাষার স্বরূপ সন্ধান এবং অবশ্যই কিছুটা নিজের ঢাক পেটানোর জন্য-
বহুমাত্রিক লেখক ফরিদ আহমদ দুলাল। কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, লোকগবেষক, সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠক, এরকম আরো কত-কিছু। তার সঙ্গে আমার যৎকিঞ্চির পরিচয় ছিল লেখার সূত্রে। দেখাও যে হয়নি এমন নয়, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার শুরু দেড় যুগ আগে। কবি মাহমুদ কামালের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম এক সাহিত্য সভায় প্রধান আলোচক হয়ে। আমার মূল বক্তব্য ছিল কবিতার নির্মাণকলা আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা। সেই সভায় পঠিত কবিতাগুলোর ওপর আলোচনা করেছিলেন দুলাল। তখনই তার মননশীলতার বিশেষ পরিচয় পাই। পরবর্তীকালে কবিতা বিষয়ে দুলালের গভীর অনুসন্ধিৎসা এবং প্রজ্ঞার স্বাক্ষর বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি আমি।
সেবার আমার টাঙ্গাইল যাবার আরেক মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল টাঙ্গাইল শহরের অদূরে প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পাথরাইল গ্রাম সরেজমিনে পরিদর্শন। আমার সঙ্গী আশরাফুজ্জামান ছাড়াও টাঙ্গাইলের এক তরুণ অধ্যাপক আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করছিলেন। পাথরাইলে পৌঁছেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম। কাজ মানে জরিপ। জরিপের জন্য আগে থেকেই আমরা করে রেখেছিলাম একটি ফরম্যাট। তাকে অনুসরণ করে তথ্য। এই ফরম্যাটেরই একটা অংশ ছিল আর্থিক মূল্যায়ন। একবারে আনকোরা হয়েও দুলাল সেই ফরম্যাটটি অবলীলায় আয়ত্ত করে নিলেন। ফলে আমার কাজ অর্ধেক কমে গেল। আমি ছোট্ট টেপ-রেকর্ডার হাতে ইন্টারভিউ করছি, প্রশ্ন-উত্তর করছি, জামান মুভি ক্যামেরায় তা ধারণ করছেন, আর দুলাল দ্রুত হাতে মূল বিষয়গুলো লিখে নিচ্ছেন।
সারাদিন লেগে গেল পাছরাইল নামক এই অনন্য গ্রামটির ছয় শতাধিক তাঁতি পরিবারের অনুপূর্ব জরিপ শেষে টাঙ্গাইলে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রেস্ট হাউজে ফিরতে। রাতে আহার ইত্যাদির পর পুরো প্রতিবেদনটি তৈরি হলো বাংলায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ল্যাপটপে তার ইংরেজি অনুবাদ করে নিলাম।
পুরোটা দিন আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, দুলাল কেবল হিসাব-নিকাশে বা তথ্যাবিশ্লেষণেই পারঙ্গম নন, তিনি লোকসংস্কৃতিতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অঙ্গীকৃত। আমি তখন পুরো বাংলাদেশকে মোট আটটি লোকসাংস্কৃতিক এলাকায় ভাগ করে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি এলাকা সফর করছি এবং লোকসংস্কৃতির আর্থিক মূল্যমান নির্ণয়ের জন্য একটি পরীক্ষামূলক চিরুনী-জরিপ সম্পাদন করে চলেছি। আর প্রতিটি এলাকার সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছি একেকজন মুখ্য গবেষককে। ভাবছিলাম ময়মনসিংহ এলাকার দায়িত্ব হয়তো ওই এলাকার কোনো কলেজের প্রবীণ কোনো গবেষক অধ্যাপককে দেব। কিন্তু দুলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি ভিন্ন চিন্তা করতে শুরু করলাম। তারপর প্রায় অঘোষিত পরীক্ষা হিসেবে আমি তাকে আমার প্রদত্ত ফরম্যাট অনুযায়ী বৃহত্তর ময়মনসিংহের ওপর একটি প্রতিবেদন দিতে বললাম। ভাবছিলাম হয়তো পৃষ্ঠা দশেকের এক প্রতিবেদন আমি পাব।
কিন্তু আমাকে অবাক করে তিনি প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার একটি সুবিস্তত প্রতিবেদন দিলেন, যা প্রত্যক্ষত তার বহুদিনের সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার ফল। সেই থেকে দুলাল আমার সর্বকাজে মূলত সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়ালেন। আমি লোকবাংলা নামক একটি সংগঠন করলাম লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার জন্যে। দুলাল তাতেও প্রায় সার্বক্ষণিক শ্রম ও মেধা দিতে লাগলেন। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তার একটি গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে পেরে, কেননা ওটি বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে তার একক সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার প্রশংসনীয় স্বাক্ষর। সন্দেহ নেই, এই গ্রন্থের বিষয়-বিন্যাসে জেনেভাস্থ ওয়ার্লড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেশন প্রদত্ত গাইডলাইন ও মৎপ্রদত্ত রূপরেখা প্রধানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রথমে প্রতিটি জেলার পরিচিতি, তারপর মূর্ত (টেনজিবল) ও বিমূর্ত (ইনটেনজিবল) এই দুই প্রধান শাখায় সব লোকসাংস্কৃতিক উপাদান ও অভিব্যক্তিকে ভাগ করে আইটেমমাফিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিষয়টা খানিকটা জাল দিয়ে পুকুরের সব মাছ ছেঁকে আনার মতো। তারপর মাছগুলো শ্রেণি ও নাম অনুযায়ী আলাদা করে প্রতিটির বর্ণনা, বিশেষত্ব, সম্ভাব্য দাম ও তার সর্বমোট মূল্যমান প্রাক্কলন করার মতো। সবচেয়ে কঠিন কাজ মেধাস্বত্ব নির্ধারণ, যার ফলে এই মূর্ত ও বিমূর্ত সম্পদের একটি আনুপূর্বিক মূল্যমান নির্ণয় করা সম্ভব। প্রথাগত লোকসাংস্কৃতিক গবেষণায় এটি একটি নতুন মাত্রা। বলা বাহুল্য, বিশ্বে লোকসংস্কৃতি শনাক্তকরণ, তার মূল্যমান নির্ণয় ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে এই পদ্ধতির প্রায়োগিক সাফল্য অপরিসীম। আমাদের সৌভাগ্য, এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। দুলালের গবেষণা সেই ঘরানারই প্রত্যক্ষ ফসল। আসলে দুলাল আমাকে যে ৫০ পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি দিয়েছিলেন, তারই সম্প্রসারিত ও প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপ তার ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান’ গ্রন্থটি।
লোকসংস্কৃতি মূলত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত লোকমনীষার ক্রমবিবর্তিত রূপ। এখানে প্রচলিত অভিব্যক্তির পাশাপাশি রয়েছে বিপন্ন, প্রায় বিলুপ্ত আর বিলুপ্ত অভিব্যক্তিরও ছায়া-রূপ। এই শেষোক্ত অভিব্যক্তি শনাক্তকরণ বা তার সম্ভাব্য পুনরুজ্জীবন একটি দুঃসাহসিক কাজও বটে। দুলাল এ ধরনের কিছু অভিব্যক্তির ছায়া-রূপ শনাক্তকরণেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
আর প্রচলিত প্রায় সব মৌখিক, লৌকিক ও হস্তশিল্প জাতীয় প্রকরণ দলিলীকরণ করেছেন। বলা বাহুল্য, এই ফরম্যাট অনুসরণ করে আমি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘বাংলাদেশের লোকসংগীত’ নামক একটি প্রামাণ্য গবেষণাগ্রন্থ সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছি কয়েক বছর আগে। দুলাল সেখানেও একই বিষয়ে একটি অনুসন্ধিৎসু প্রবন্ধ জমা দিয়েছিলেন। বর্তমান গবেষণায় সেটিও সহায়ক হয়েছে বলে মনে করি। যেসব বিষয়ে এই গ্রন্থে অপূর্ণতা থেকে গেল তা পরবর্তী সংস্করণে (যদি হয়) দূর করা বাঞ্ছনীয়। কেননা বিশেষ সময়ের পর উপকরণ, অভিব্যক্তি ও প্রকাশভঙ্গি সাধারণত বদলে যাওয়াই লোকসংস্কৃতির সচল রীতি।
গ্রন্থটি পাঠক-গবেষক সকলের কাজে আসবে বলে মনে করি। কেননা তৃণমূলীয় সংস্কৃতিই একটি জনগোষ্ঠীর তথা জাতির অবিকৃত ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্ত। দুলালকে অভিনন্দন, এমন একটি সময়ানুগ ও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য।
এ ধরনের গ্রন্থ যত বহুল পঠিত হবে, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। ফরিদ আহমদ দুলালের মতো একজন নিষ্ঠ কবি, গভীর মননের প্রাবন্ধিক, বহুল আলোচিত নাট্যকার সর্বমহলে সমাদৃত হবেন- এই প্রত্যাশা আমার।
(ভূমিকা \ বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান \ ফরিদ আহমদ দুলাল \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি ও কাব্যকোবিদ, জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্ম দরিয়ানগর খ্যাত কক্সবাজারে। দরিয়ানগরে জন্ম নিয়ে তিনি কাব্যসৃষ্টিতে দরিয়া চারিত্র্য ধারণ করেছেন। দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা মাড়িয়ে যাওয়া সহজসাধ্য নয়। তার কবিতায় বাংলার সংস্কৃতি ও প্রকৃতি, বাঙালি জাতির বিকাশ, বাঙালির শৌর্য ও সংগ্রাম নানামাত্রিক ব্যঞ্জনায় উচ্চারিত হয়েছে; প্রাগ্রসর মানুষ তাই যৌক্তিকভাবেই তার নামের সঙ্গে ‘জাতিসত্তার কবি’ অভিধা যোগ করেছেন।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সাম্প্রতিক কবিতার দিকে এবার দৃষ্টি দেয়া যাক; নিরন্তর তিনি লিখে চলেছেন নতুন নতুন কবিতা। আসুন একটি কবিতা পাঠ করা যাক, যে কবিতা এখনো কোনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি-
মধ্যরাতে জেগে ওঠে
কবিতার কবি,
মধ্যরাতে জেগে ওঠে
কবির কবিতা;
কে কার বন্ধনে মুক্ত,
কে কার অঙ্গনে?
তুমি হও, তুই হোস্,
যার গন্ধ যে নে।
আমরা শয্যার ওমে
পরস্পর পরিচর্যা করি,
দেহের আধারে মন
প্রাণে প্রাণে ধরি;
তথাগত, এইমতো
কবিকে অমর করে
কবিতাকবরী।
(কবিতাকবরী \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
কবি যেন তার প্রাত্যহিক অনুষঙ্গকে কবিতায় তুলে আনতে চান নিপুণ মুন্সিয়ানায়। এভাবে তিনি তার পাঠককে নতুন চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে চান, তা নয়, তিনি নবীনতম কবিকেও তার কাব্যযাত্রায় সতীর্থ করে নিতে চান। কবি নিজের প্রত্যাশা এবং প্রেমাকুতিকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতেও কবিতার আশ্রয় নেন; আসুন তেমন একটি কবিতা পড়ে নেয়া যাক-
চেয়েছিল কেউ দখল করতে? দখল করিনি আমি;
কে কাকে কখন করেছে দখল জানেন জগতস্বামী।
দেখেছি তোমাকে তোমার গভীরে এফোঁড় ওফোঁড় ঘুরে
বৃত্তাকারেই ফেরে সব দেখা, কখনো-বা যায় উড়ে।
……………………
বাবেল পেরিয়ে হাবেল কাবেল তোমার বংশধর,
প্রাণ থেকে প্রাণী চরকুড়েঘর, ঘ্রাণে ঘ্রাণে নারী-নর।
দেশ থেকে দেশে, বেশ থেকে বেশে চন্দ্র-সূর্যে এসে
এক থেকে বহু, বহু থেকে এক দেহে মনে এসে মেশে।
……… ……….. …………
তাই কি হঠাৎ তোমাকে হারিয়ে তোমাকেই পেয়ে যাই?
পাই বা না পাই, দখলপ্রবণ তোমাকেই শুধু চাই।
(দখলপ্রবণ \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
জাতিসত্তার কবি নামে আমরা সবাই তাকে জানি; এই জাতিসত্তার বিষয়টিকে আমি ‘শিকড় সংলগ্নতা’ও বলতে চাই দিগন্ত মাড়িয়ে তিনি বারবার ফিরে আসেন তার শিকড়ের টানে দরিয়ানগরে। নিজের শিকড়ের কথাটি উচ্চারণ করতে কখনোই তিনি ভুল করেন না; আসুন পড়া যাক নিচের কবিতাটি-
এই দরিয়ানগরের
ঝাউয়ের আড়ালে
নীলঢেউ
দেখলো না রূপচান্দা
এই দুপুুরেও
লালকাঁকড়ার
চোখগুলি
আন্ধা
দেখছি কেবল আমি
দেখছো কেবল তুমি
দেখাই যে
আমাদের
যুগলধান্ধা
(দুপুরসাগর \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
সেই যে তিনি বলেছেন- ‘যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ/ দরিয়ানগরে জন্ম পৃথিবীর সর্বপ্রান্ত আমার স্বদেশ।’ পরিব্রাজক কবির তৃষ্ণা যেন মিটতে চায় না সহজে; তাই তিনি অজস্র পথ হেঁটে, অগণন সুন্দরের স্পর্শ পান করেও অকপট বলেন-
দেখার আগেই
তোমাকে এঁকেছি,
আঁকতে আঁকতে
স্বরূপ দেখেছি,
দেখতে দেখতে
তবুও শিখিনি
রংতুলি ছলাকলা;
যে কথা লিখছি
কোটি কোটি বার,
সে কথা হয় না বলা।
(কথা \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
অপার তৃষ্ণা থেকেই হয়তো তিনি ছড়িয়ে দিতে চান আগামী প্রজন্মের নতুন কবিদের কাছে। নতুনকে আবাহন করতে গিয়েই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা উচ্চারণ করেন-
মিশে গেলেই তো সবটুকু মিশে যাওয়া হয় না;
ন্যূনতম দূরত্বটা কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে;
আমাদের অনঙ্গমে যার জন্ম, সে কথা কয় না;
শেষমেশ সে-ও কি দাঁড়িয়ে থাকে তৃতীয়ের বাঁকে?
…………………………..
তোমার ভিতরে আমি, আমার ভিতরে তুমি চিরমনপ্রিয়;
তৃতীয় সত্তার কাছে মনবন্দি, আমরা তো পূর্বস্মরণীয়।
(চিরমনপ্রিয় \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
এভাবেই প্রেম আর দার্শনিকতার দ্যুতিতে কবি নিজের চলমান পথটিকে প্রসারিত করে দিতে চান নতুনের আবাহনে; তার এ আবাহন যতটা সর্বজনীন, ততটাই প্রতীকী। স্বপ্নকে ছুঁতে হবে স্বপ্ন দিয়ে, আত্মার ধ্বনি কেবল আত্মাই শুনতে পায়; প্রজ্ঞার পাঠ নিতে হবে প্রজ্ঞার আলোয়; নতুন প্রজন্ম যেন তার প্রজ্ঞার আলো চিনে নিতে ভুল না করে, সে জন্য নতুনেরা নিজেকে আলোকিত করে নেবেন ধ্যানমগ্ন প্রজ্ঞায়; এই আমার প্রত্যাশা।
একটু খোলাসা করে বলি- এমন একটি কবিতাসরণির নাম কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। মূলত কবিতারই সরণি। উপসরণি আছে অনেক। কোনোটা রেখা-রেখা আলোর মতো রংঝরা। বিজ্ঞান নয়, আমাদের দেখার আনন্দ বলে, আলো যত দূরে যাবে, ততই রঙিন। আমরা যেই কবিতাসরণির কথা বলছি, এর উপসরণি অদূরে সুদূরে গিয়ে হয়ে উঠেছে রঙিন আলোর ফোয়ারা। উপসরণির কিছু পৌঁছেছে ছোট-বড় নানা জলস্থানে। জলস্থান তো শুধু জলের সমষ্টি নয়, এখানে নুয়ে নেমে থাকে আকাশের আলো, মেঘের চঞ্চল ছায়া।
কবিতাসরণিটির এগিয়ের যাওয়া নিরেট সোজা ও সমতল নয়। বন্ধুরতা আছে, আছে বর্ণিল বাঁক। কোথাও কাঁকড়, বালি, কাদা। বন-উপবন পাশ ছুঁয়ে আছে। মাঠ ছাড়িয়ে মাঠ, নদী, খাড়ি আছে টলোমলো ঝিল, শাপলার ঠোঁটচাপা হাসি।
এগুলো হলো ইঙ্গিতকথা। মূলকথা- কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে বলছি বটে কবিতাসরণি, তার সাহিত্য-সম্ভারটি অনেক কিছু, সকল কিছু মিলেই সমৃদ্ধ হয়েছে। মূলত এবং মুখ্যত তিনি কবি এবং কবিই। প্রবাদে আছে না, ‘যে রাধে, সে চুলও বাঁধে’। অনেক কালজয়ী এবং সমকালীন কবির মতো মুহম্মদ নূরুল হুদাও ‘রান্না’র মূল কাজটি করার পাশাপাশি পরিপাটি করে ‘চুল বেঁধেছেন’, অর্থাৎ অবিশ্রান্ত কবিতা লেখার প্রায় সমান্তরালে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন। তিনি গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, কথাসাহিত্য, শিশু-কিশোর সাহিত্য, গান, সাহিত্য-কলাম গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন।
আমি দীর্ঘদিন জীবিকাসূত্রে সাহিত্য সম্পাদনা করেছি। সাহিত্য-সম্পাদকের প্রধান কাজই হচ্ছে পরিকল্পনা অনুযায়ী লেখা সংগ্রহ করা। আপনি-আপনি যে লেখা আসে, সেগুলো দিয়ে ভালো কাগজ বা সাহিত্যপাতা করা সম্ভব হয় না। আরো একটি সমস্যা- নির্ভরশীল লেখক পাওয়া। ‘নির্ভরশীল’ মানে, যে লেখক প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী লেখাটি যথাসময়ে দেবেন। মুহম্মদ নূরুল হুদা আমার চিরকালের নির্ভরশীল লেখক। যখন যে লেখা চেয়েছি, পদ্য-গদ্য, আমাকে কখনো বিমুখ করেননি।
এই তো কদিন আগে, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি লেখা দিলেন, সময় পেয়েছিলেন মাত্র এক রাত। লেখা পাওয়ার সংকটে মুহম্মদ নূরুল হুদা আমাকে কতবার যে উদ্ধার করেছেন, এর গোনাগুনতি নেই। তিনি অনেক লেখা লিখেছেন আমার পীড়াপীড়ি এবং ‘নাছোড়’ উৎপাতের করণে। একসয় ‘পূর্ণতা’ নামে দ্বিমাসিক একটি সাহিত্য কাগজ বেরোত। লতা হুসেন ছিলেন সম্পাদক। আমি ছিলাম নির্বাহী সম্পাদক। ওই কাগজে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘উইড়া যা রে হংসপঙ্খী’ শীর্ষক একটি কলাম লিখতেন। সাহিত্য, এর সঙ্গে তত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, সমকাল, দিকচিহ্নহীন মহাকাল- কতকিছুর মিশেল থাকত।
একবার আমাদের এক অনুজ একটি দৈনিকের ‘ঈদসংখ্যা’ সম্পাদনা করছেন। উৎসাহী হয়ে আমি তাকে সহযোগিতা করছি। কয়েকজনের সঙ্গে মুহম্মদ নূরুল হুদার লেখা জোগাড়ের দায়িত্ব নিয়েছি। তার ঘাড়ে চাপিয়েছি গল্প লেখার ভার। আমার নাছোড় চাপাচাপিতে তিনি গল্প লিখলেন। গল্প আগেও লিখেছেন। মুহম্মদ নূরুল হুদা নিশ্চয় কবুল করবেন, ‘লগি’ শীর্ষক গল্পটি তার লেখা অতিউল্লেখযোগ্য একটি গল্প।
দুই.
আমরা যারা ঢাকা শহরে ডেরা পেতেছি, তাদের অধিকাংশ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা। মুহাম্মদ নূরুল হুদা এসেছেন কক্সবাজার থেকে। কক্সবাজারকে তিনি বলেন ‘দরিয়া নগর’। সেই বিবেচনায় মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘দরিয়া নগরের ভূমিপুত্র’। তার প্রিয় অগ্রজপ্রতিম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমন প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘হুদার (কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা) বাড়ি কক্সবাজার উপজেলাতেই, সমুদ্র আর পাহাড়ের গা ছুঁয়ে। প্রথম দেখাতেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার মতো দীপ্তি ছিল হুদার মধ্যে। দীর্ঘ, ছিপছিপে, সুদর্শন হুদার গায়ের রং ছিল ফর্সা, নাক তীক্ষè, ভ্রæ ঘন কালো, চোখ আয়ত। দেখলই বোঝা যেত সমুদ্র-বন্দর চট্টগ্রামে যে আরব-বণিকেরা দূর-অতীতে এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের শরীরিক বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার জ¦লজ¦ল করছে সেই চেহারায়।’
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সঙ্গে আমার পরিচয় কবে, সে কথা স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া কঠিন। বরং বলা যায়, আমার ঢাকার জীবনের সূত্রপাত-কালে, যে কজন উজ্জ্বল তরুণ কবির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে, মুহম্মদ নূরুল হুদা তাদের একজন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রæমুক্ত হলে আমি ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় চলে আসি। তখনো সড়ক, রেল যোগাযোগব্যবস্থা চালু হয়নি। জন্ম শহর ভৈরব থেকে একটি পরিচিত পরিবারের সঙ্গে নৌকায় ঢাকায় আসি। তখন থেকেই হুদা ভাইকে (আরো কেউ কেউ ছিলেন) চিনি। মেশামেশি, সহযাত্রী- পঞ্চাশ বছর তো অতিক্রম করেছি। সম্পর্কের জোয়ার-ভাটা হয়েছে কারো কারো সঙ্গে। অগ্রজের ভালোবাসা আর অনুজের সমীহসৌন্দর্যের মধ্যে আমাদের সম্পর্ক এখনো বলবৎ আছে ।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা কবিতায় যাদের উত্থান এবং বিকাশ, এদের মধ্যে প্রথম কাব্য বের হয় নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সামান্য আগে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত প্রথম কাব্য মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ (১৯৭২)। এ বছরই ডিসেম্বর মাসে বের হয় আবুল হাসানের প্রথম কাব্য ‘রাজা যায় রাজা আসে’।
সেই সময় উঠতি কবিদের সকাল-বিকাল আড্ডা হতো নিউমার্কেটের ‘মনিকো’ রেস্টুরেন্টে। এক সন্ধ্যায় মুহম্মদ নূরুল হুদা এলেন, হাতে তার সবে প্রকাশিত কাব্যটি। তখন তো এত এত বই বেরুত না, কালেভদ্রে
একটি-দুটি। নতুন কোনো বই বেরুলে সাহিত্যমহলে খবর রটে যেত।
প্রথম বই প্রকাশের যে উত্তেজনা ও আনন্দ, তা হুদা ভাইয়ের চোখে-মুখে ছিল না। কারণ জানা গেলে, বইটিতে কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। সবাই সান্ত¡না দিচ্ছে, বই তো বেরিয়েছে, বানান ভুল পরে সারানো যাবে। হুদা ভাইয়ের মন একটু একটু ভালো হচ্ছে। কয়েকটি যে ভুল ছিল, কলমে সারিয়ে বন্ধু কবিদের উপহার দিলেন। আমিও পেলাম এক কপি। বইয়ের শরীরে তখনো রং-বাঁধাইয়ের কাঁচা গন্ধ লেগে আছে। ‘তরুণ কবিকে…’ নিচে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার স্বাক্ষর। দেখার মতো এমন স্বাক্ষরযুক্ত হুদা ভাইয়ের অধিকাংশ বই আমার সংগ্রহে আছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘হাজার কবিতা’। এ বইটি প্রিয় কবিদের গ্রন্থের সঙ্গে আমার হাতের নাগালেই থাকে। এটিও কবি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। যথারীতি তাৎক্ষণিক কবিতামতো লেখা, নিচে সেই নান্দনিক স্বাক্ষর। তিনি লিখলেন-
‘কবি
ফারুক মাহমুদ
কবির মুহূর্ত মানে মহাকাল, নয় বুদবুদ
মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী, কবি তার সাক্ষী সাবুদ’
প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘সকালটা দেখে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে’। অধিকাশ লেখকের প্রথম গ্রন্থ পাঠেই আন্দাজ করা যার তার ভবিষ্যৎ লেখক-সক্ষমতা। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বেলায় তা-ই হয়েছিল। প্রথম কাব্যের নামটাই চককে দেয়ার মতো, ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’। স্বাভাবিক হতো ‘সমুদ্রে শোণিত পাত’ লিখলে। আমাদের শ্রবণ-সহ্যতায় অভিনব ধ্বনি, চিন্তার জগতে নতুন সূত্র। কবি যখন উচ্চারণ করেন, ‘অনন্তর অবয়বে শব্দিত পতন, …’ পাঠক শুনতে পান নতুন অনন্তর পদধ্বনি, অবশেষহীন ধ্বনি ছাড়িয়ে আরো আরো ধ্বনি।
শুরুর সেই স্বচ্ছ গভীর দৃঢ় ঋজু রঙিন পদধ্বনি, এত সময় পেরিয়েও চলমান। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিপুল দক্ষতায় লিখে যাচ্ছেন, কোনো ছেদ নেই। শুধু ছন্দদক্ষতা নয়, শুধু শব্দের সৌরভ নয়, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকের ব্যঞ্জনার বৈকারণিক মান্যতা নয়, তিনি তার প্রতিটি রচনাকে ‘কবিতা’ করে তোলেন। আবেগকে দাঁড় করান যুক্তির পাশে, মুখোমুখিও। এরপর সৃজনের কোন আলো, সে সিদ্ধান্ত কবির। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করতে জানেন।
বেসুমার কবিতার স্রষ্টা মুহম্মদ নূরুল হুদা। তার কাব্যপ্রবণতা নিয়ে বিস্তর লেখার আছে। তবে আজকের লেখায় সেই সাহস দেখালে সফল হব না। আমার যোগ্যতার প্রশ্নটি তো আছেই, প্রচার-পরিসরটাও মাথায় রাখতে হলো। তবে একটা কথা না বললেই নয়, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নতুন শব্দ তৈরির ক্ষমতাটি বিস্ময়কর। সমাসবদ্ধ করে দুটি শব্দকে একশব্দ করে তৈরি করেন নতুন অর্থ-ব্যঞ্জনায়।
পঁচাত্তরতম জন্মদিনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সকলের প্রিয় হুদা ভাইকে শুভেচ্ছা।
একটি-দুটি। নতুন কোনো বই বেরুলে সাহিত্যমহলে খবর রটে যেত।
প্রথম বই প্রকাশের যে উত্তেজনা ও আনন্দ, তা হুদা ভাইয়ের চোখে-মুখে ছিল না। কারণ জানা গেলে, বইটিতে কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। সবাই সান্ত¡না দিচ্ছে, বই তো বেরিয়েছে, বানান ভুল পরে সারানো যাবে। হুদা ভাইয়ের মন একটু একটু ভালো হচ্ছে। কয়েকটি যে ভুল ছিল, কলমে সারিয়ে বন্ধু কবিদের উপহার দিলেন। আমিও পেলাম এক কপি। বইয়ের শরীরে তখনো রং-বাঁধাইয়ের কাঁচা গন্ধ লেগে আছে। ‘তরুণ কবিকে…’ নিচে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার স্বাক্ষর। দেখার মতো এমন স্বাক্ষরযুক্ত হুদা ভাইয়ের অধিকাংশ বই আমার সংগ্রহে আছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘হাজার কবিতা’। এ বইটি প্রিয় কবিদের গ্রন্থের সঙ্গে আমার হাতের নাগালেই থাকে। এটিও কবি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। যথারীতি তাৎক্ষণিক কবিতামতো লেখা, নিচে সেই নান্দনিক স্বাক্ষর। তিনি লিখলেন-
‘কবি
ফারুক মাহমুদ
কবির মুহূর্ত মানে মহাকাল, নয় বুদবুদ
মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী, কবি তার সাক্ষী সাবুদ’
প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘সকালটা দেখে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে’। অধিকাশ লেখকের প্রথম গ্রন্থ পাঠেই আন্দাজ করা যার তার ভবিষ্যৎ লেখক-সক্ষমতা। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বেলায় তা-ই হয়েছিল। প্রথম কাব্যের নামটাই চককে দেয়ার মতো, ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’। স্বাভাবিক হতো ‘সমুদ্রে শোণিত পাত’ লিখলে। আমাদের শ্রবণ-সহ্যতায় অভিনব ধ্বনি, চিন্তার জগতে নতুন সূত্র। কবি যখন উচ্চারণ করেন, ‘অনন্তর অবয়বে শব্দিত পতন, …’ পাঠক শুনতে পান নতুন অনন্তর পদধ্বনি, অবশেষহীন ধ্বনি ছাড়িয়ে আরো আরো ধ্বনি।
শুরুর সেই স্বচ্ছ গভীর দৃঢ় ঋজু রঙিন পদধ্বনি, এত সময় পেরিয়েও চলমান। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিপুল দক্ষতায় লিখে যাচ্ছেন, কোনো ছেদ নেই। শুধু ছন্দদক্ষতা নয়, শুধু শব্দের সৌরভ নয়, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকের ব্যঞ্জনার বৈকারণিক মান্যতা নয়, তিনি তার প্রতিটি রচনাকে ‘কবিতা’ করে তোলেন। আবেগকে দাঁড় করান যুক্তির পাশে, মুখোমুখিও। এরপর সৃজনের কোন আলো, সে সিদ্ধান্ত কবির। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করতে জানেন।
বেসুমার কবিতার স্রষ্টা মুহম্মদ নূরুল হুদা। তার কাব্যপ্রবণতা নিয়ে বিস্তর লেখার আছে। তবে আজকের লেখায় সেই সাহস দেখালে সফল হব না। আমার যোগ্যতার প্রশ্নটি তো আছেই, প্রচার-পরিসরটাও মাথায় রাখতে হলো। তবে একটা কথা না বললেই নয়, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নতুন শব্দ তৈরির ক্ষমতাটি বিস্ময়কর। সমাসবদ্ধ করে দুটি শব্দকে একশব্দ করে তৈরি করেন নতুন অর্থ-ব্যঞ্জনায়।
পঁচাত্তরতম জন্মদিনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সকলের প্রিয় হুদা ভাইকে শুভেচ্ছা। এই জন্মদিন পৌঁছে যাক শত জন্মদিনে।
সালমা বেগ :: বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ষাটের অন্যতম কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ৭৫তম জন্মদিনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি-নাট্যকার-প্রাবন্ধিক ফরিদ আহমদ দুলালের গবেষণাগ্রন্থ ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় রূপান্তর’। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রæব এষের প্রচ্ছদে ১২০ পৃষ্ঠার এ গবেষণা গ্রন্থের মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা; দৃষ্টিনন্দন বইটি হাতে নিয়েই পড়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
“মুহম্মদ নূরুল হুদা বাংলা কবিতার এক অনিবার্য নাম। তার কবিতার বৈভব বাংলা কবিতায় যুক্ত করেছে বৈচিত্র্যময় এবং বলবান বিভা। কবিতায় অর্ধশতাব্দীর অধিককালের সদর্প পদচারণার পরও অদ্যাবধি তিনি কবিতার নতুন রীতি ও প্রকরণ আবিষ্কার করে চলেছেন। কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, লোকনন্দন, ভ্রমণগদ্য, স্মৃতিকথা, সম্পাদনা সর্বক্ষেত্রে তার অর্জন ও অন্বেষণ সমীহ-জাগানিয়া। গণমানসে ‘জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে অভিষিক্ত মুহম্মদ নূরুল হুদা বর্তমানে বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা ও সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম বিষয়ে নয়টি বিশ্লেষণধর্মী রচনার সংকলন সমকালীন আরেক বিশিষ্ট কবি ও নাট্যজন ফরিদ আহমদ দুলালের এই গ্রন্থ ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার রূপান্তর’। এই গ্রন্থে মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার সূত্রে বাংলা কবিতার এক বিশিষ্ট অধ্যায়ের বিশ্লেষিত রূপ পাঠককে ঋদ্ধ করবে।” বইটি সম্পর্কে প্রকাশনা সংস্থার এ বয়ানকে যথার্থ মনে করে গোড়াতেই তা উদ্ধৃত করলাম।
আসুন আমরা এবার দেখি এই বইয়ে কী আছে। এই বইয়ে মোট নয়টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে-
১। মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় রূপান্তর
২। কবি ও কাব্যোকোবিদ মুহম্মদ নূরুল হুদা
৩। বাংলা কবিতায় সুফিবাদী চেতনা ও মুহম্মদ নূরুল হুদা
৪। কবিতা বাংলার সংগঠক মুহম্মদ নূরুল হুদা
৫। জাতিসত্তার কবি এবং বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম
৬। নতুনের আবাহনে মুহম্মদ নূরুল হুদা
৭। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ভাষাশৈলী
৮। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় বাংলাদেশ ও প্রকৃতি
৯। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পর্কে গুণীদের অভিমত।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-নাট্যকার-গবেষক ফরিদ আহমদ দুলাল বাংলা নাটকে অবদানের বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও কবিতায় তার বুৎপত্তি কতটা গভীর তার কিছুটা প্রমাণ অবশ্যই
ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় রূপান্তর’ গ্রন্থটি পড়ে।
বইটির ভূমিকায় কবি ফরিদ আহমদ দুলাল লিখেছেন- ‘কবিতার একজন নিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আমি মুহম্মদ নূরুল হুদার ভক্ত। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের সখ্যের কারণে, বিভিন্ন সময় তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকা-ম্যাগাজিনে আমার বেশ কিছু গদ্য লেখা হয়েছে। সুযোগ থাকলে আমি তাঁকে নিয়ে একটা সন্দর্ভ রচনার চেষ্টা করতাম; কিন্তু সে সুযোগ যেহেতু আমার নেই, তাই বিভিন্ন সময় তাঁকে নিয়ে লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে এ গ্রন্থ রচনার চেষ্টা করেছি।
বলতে দ্বিধা নেই, মুহম্মদ নূরুল হুদা যত বড় মাপের লেখক, তাতে তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা আমার জন্য ধৃষ্টতাই বটে; কিন্তু বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার দাবিতে শেষ পর্যন্ত গ্রন্থটি রচনা করা হলো। বইটি মলাটবন্দি হবার আনন্দে যতটা আপ্লুত আমি, ততটা প্রকাশ করাও আমার পক্ষে দুঃসাধ্য; তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার প্রতি কবির আস্থাই দায়বদ্ধ করেছে আমায়।
মুহম্মদ নূরুল হুদা আমার বন্ধু তো বটেই, তার চেয়ে বেশি তিনি আমার অগ্রজ-উপদেশক এবং মাথার ওপর ছায়াবৃক্ষ। গ্রন্থটি যদি কবিতা বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের সামান্যও মনোযোগ কাড়ে, যদি নতুন প্রজন্মের কবিতাকর্মী ও কাব্যসমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে, তাহলে আমার শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি।…’
কবি-কাব্যকোবিদ ফরিদ আহমদ দুলালের এ অসাধারণ গ্রন্থটি পাঠের পর আমি আমার অনুভূতি উপস্থাপন করতে চাই এভাবে-
আমার সংক্ষিপ্ত কাব্য জীবনের অভিজ্ঞতায় জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আমার চোখে দূর থেকে দেখা উজ্জ্বল নক্ষত্র, আর ফরিদ আহমদ দুলাল ঘনিষ্ঠ-আন্তরিকতায় পড়া অনিন্দ্য বিস্ময়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমি কবিকে নিয়ে ফরিদ আহমদ দুলালের যত লেখা পড়েছি, তাতে নিশ্চিত করে বলতে পারি, নয়টি প্রবন্ধের বাইরেও কিছু গদ্য এ সংকলনে যুক্ত হয়নি; কেন হলো না জানি না; আগামীতে সেগুলো যুক্ত হলে গ্রন্থটি অধিকতর পূর্ণতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
দুই প্রিয় কবি-ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে গবেষণা গ্রন্থটি মহার্ঘ্য হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে এ কথাটি আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে গ্রন্থটি এ বিশ্বাস আমরা করতেই পারি। বইটি প্রসঙ্গে দু’চার পঙ্ক্তি লিখে আমি সাহিত্যের দুই দিকপালের পাশে নিজের নামটি যুক্ত করতে পারলাম, সে কি আমার কম সৌভাগ্য! লেখক-প্রকাশক দুজনকেই অভিনন্দন। বইটি যেহেতু কবির পঁচাত্তরতম জন্মদিনে প্রকাশিত, এ সুযোগে কবিকে আমার এবং আমার পাঠকের পক্ষ থেকেও জন্মদিনের শুভকামনা জানাই।
Posted ২:২৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta