কক্সবাংলা ডটকম(৩ অক্টোবর) :: গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে কয়েকজন সন্ত্রাসী গুলি করে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুহিবুল্লাহ এমন একজন নেতা, যার বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যেও মুহিবুল্লাহর ছিল বিপুল জনপ্রিয়তা।
মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফর্টিফাই রাইটসসহ বিশ্বের বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করারও আহ্বান জানিয়েছে এসব মানবাধিকার সংস্থা।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একটা মাত্রা আছে এবং সে কারণেই পৃথিবীর সব নামজাদা সংবাদপত্র মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে দ্য গার্ডিয়ান, আলজাজিরা, বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রভৃতি পত্রিকা বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের নিউজ কাভার করেছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ, আলোচনা ও টকশো প্রচার করেছে। এমনকি অনেককে বলতে শুনেছি, ‘মুহিবুল্লাহ যে এত বড় রোহিঙ্গা নেতা, এটা আগে জানতাম না।’ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘মুহিবুল্লাহকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইলো যে তিনি বড় নেতা ছিলেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে কে এই মুহিবুল্লাহ? ২০১৯ সালের আগে মুহিবুল্লাহকে কিছু রোহিঙ্গা ছাড়া তেমন কেউ সত্যিকার অর্থে চিনত না। তবে মুহিবুল্লাহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘মুহিবুল্লাহ মাস্টার’ নামে পরিচিত। কেননা, ২০১৭ সালের আগস্টের জেনোসাইডের ঘটনার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে মুহিবুল্লাহ রাখাইনের মংডু টাউনশিপের একটি স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি তখন থেকেই ‘মুহিবুল্লাহ মাস্টার’ নামে পরিচিত। তবে বাংলাদেশে আসার কয়েক মাস পর মুহিবুল্লাহ ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর পর থেকেই মুহিবুল্লাহ ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে শুরু করেন।
সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে পারার যোগ্যতা, জনসংযোগের নেতাসুলভ সক্ষমতা, রোহিঙ্গা জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা করার প্রবণতা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখা, সাধারণ রোহিঙ্গাদের ছোটখাটো সমস্যা সমাধানে পারঙ্গমতা এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিংয়ে দক্ষতা প্রভৃতির কারণে মুহিবুল্লাহ ক্রমেই পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি ক্যাম্পে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং তাদের কাজে সহায়তার কারণেই ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনায়ও মুহিবুল্লাহ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার যখন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, মুহিবুল্লাহ সে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সফল করার জন্য সরকারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল, যদিও সে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিশ্বের ১৭টি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ২৭ জন প্রতিনিধির একজন হিসেবে মুহিবুল্লাহ তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দেয়।
ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং জাতিসংঘে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ মুহিবুল্লাহকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি ও বৈধতা দেয়। এরপর দেশে ফিরে এসে ২০১৯ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (ক্যাম্প-৪-এর এক্সটেনশনে) রোহিঙ্গা জেনোসাইডের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বিরাট সমাবেশ করে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন। এ ঘটনার পর মুহিবুল্লাহ সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে হাজির হন।
যদিও সরকার এ ঘটনাকে প্রাথমিকভাবে একটা বড় ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে মুহিবুল্লাহ সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা, ক্যাম্পে সক্রিয় সরকারি-বেসরকারি এবং দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য, সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সক্রিয় সমর্থন প্রভৃতিই মুহিবুল্লাহর জন্য কাল হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে।
কারা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, যারা এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লাভবান হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের জন্য দ্বন্দ্বরত বিভিন্ন ছোট দল ও উপদলের মধ্যকার সংঘাত। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় সাতটি দলের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে ক্যাম্পের পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আজ না হয় কাল মুহিবুল্লাহর হত্যার ঘটনা হয়তো ঘটত। মুহিবুল্লাহ হত্যার পরও যদি কোনো যোগ্য নেতা এভাবে নিজের যোগ্যতায় গড়ে ওঠে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের সত্যিকার নেতা হয়ে ওঠে, তাহলে তাদেরও একই পরিণতি হতে পারে। কেননা, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সে ধরনের কোনো সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এখন পর্যন্ত নেই। সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরীহ আর নেতা হওয়ার যোগ্যরা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মোটাদাগে তিন ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এক. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুহিবুল্লাহর যে গ্রহণযোগ্যতা এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুহিবুল্লাহর যে জনপ্রিয়তা, সেটা রোহিঙ্গাবিষয়ক বাংলাদেশ সরকারের এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য খুবই জরুরি, উপকারী এবং কার্যকর ছিল। কিন্তু মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার রোহিঙ্গাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন কন্টাক্ট পারসনকে হারাল। মুহিবুল্লাহর জায়গায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে তার মতো নেতা তৈরি হওয়া সময়সাপেক্ষ।
দুই. ১৯৬২ সালে যখন থেকে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী বার্মার ক্ষমতা দখল করে, তখন থেকেই রোহিঙ্গারা নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং জেনোসাইডের শিকার হয়েছে। এমনকি ২০১১ সালে অং সান সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে যখন মিয়ানমার তথাকথিত গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে, তখনও রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সে কারণেই ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। প্রায় ছয় দশকের নির্মম অত্যাচার ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরও রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
আরএসও বা আরসা নামে যেসব সংগঠন রোহিঙ্গাদের পক্ষে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের জন্য গড়ে উঠেছিল, তারাও পরবর্তীকালে তাদের কার্যকলাপ এবং প্রতিরোধের পদ্ধতির কারণে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ফলে এসব সংগঠন সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হয়ে উঠতে পারেনি। মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ সে জায়গাটি পূরণ করে ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করছিল। মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড সে জায়গাটিও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তিন. এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও একটু বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ সেনাবাহিনী কর্তৃক মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। সেখান মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার এ বিলম্বকে আরও প্রলম্বিত করবে নিঃসন্দেহে। কেননা, মুহিবুল্লাহ ও তার সংগঠন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছিল।
পরিশেষে বলব, মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যেমন ক্ষতি হয়েছে, রোহিঙ্গাদেরও একটা বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। তবে পৃথিবীতে কোনো শূন্যতাই অপূরণীয় নয়। ফলে রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকেই স্বতঃস্ম্ফূর্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন কোনো মুহিবুল্লাহর জন্ম হবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে মুহিবুল্লাহকেও যেন এ মুহিবুল্লাহর মতো নির্মমভাবে জীবন দিতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশকে। কেননা, যত দিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আছে, তত দিন তাদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে হবে।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৪ অক্টোবর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta