কক্সবাংলা ডটকম(১১ এপ্রিল) :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিছিল, প্রতিবাদ করছিল, পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের হামলা মোকাবিলা করছিল, তখন মুখোশধারী একটি গ্রুপ ভিসির বাসভবনে প্রবেশ করে ভাংচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে।
পর দিন সবার নজর যখন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দিকে, তখন একটি গ্রুপ নীরবে চারুকলা ইনস্টিটিউটে প্রবেশ করে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের জন্য তৈরী করা সব চিত্র ও সাজসরঞ্জাম নষ্ট করে ফেলে। এটি একটি বছরের অস্বস্তিকর বিদায় ও সূচনা।
রাজনীতি নয়, চাকরির সঙ্কট
পরিস্থিতিটি আসলে কাঠামোগত ও আশু প্রয়োজন- উভয়ে নিহিত থাকা আরো বড় অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ। এতে মনে হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চ হলেও- এমনকি সরকারের দাবি অনুযায়ী ততটা উচ্চ না হলেও- সুষম বণ্টন নিশ্চিতভাবেই কম। সরকারের কাছাকাছি যারা আছেন, নীতি ও সিদ্ধান্তে তারাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। আর সিদ্ধান্তগুলো বাজার অর্থনীতিবান্ধব না হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লোকজনের অনুকূলেই যাচ্ছে।
ফল হলো অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শ্রেণির মধ্যে আঁতাত। আর নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে হলেও সেখানে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত থাকে কোটা। ফলে কোটাধারীদের হাতেই সেরা চাকরিগুলো চলে যাওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। মেধার বদলে কোটার মাধ্যমে নিয়োগের ফলে কোটাধারীরা উপকৃত হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ রয়েছে। এ কোটার সুবিধা গ্রহণকারীদের অনেকেই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা নয়, তারা নানা কৌশল প্রয়োগ করে তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
অন্যান্য কোটাধারীর মধ্যে রয়েছে নারী, প্রতিবন্ধি, আদিবাসী ইত্যাদি জনগোষ্ঠী। কিন্তু ধারণা করা হয়ে থাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের অনেকেই কানেকশন ব্যবহারকারী। তারাই খুব সহজে চাকরির বাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পদগুলো হাতিয়ে নিচ্ছেন।
বিপুলসংখ্যক গ্রাজুয়েট বেকার থাকায় বেকারত্ব সমস্যা বিশাল হচ্ছে। ফলে মানসম্পন্ন চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। সেইসাথে বহিরাগত বেকারত্ব কমছে, সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়া খুবই বেশি, বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়ে গেছে। এটি একইসাথে উদ্বেগ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছে। রুচিসম্মত চাকরির সংখ্যা খুবই কম।
অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে সারা জীবনের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সুযোগ থাকে, কর্ম সম্পাদন দক্ষতা নিয়ে জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির চাহিদা থাকে, কোনো কোনো সময় নিয়োগপত্র পেতে লাখ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হতে পারে।
অনুগত হওয়ার প্রতিযোগিতা?
সরকার অবশ্যই প্রশাসনকে একটি অনুগত হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এটি কোনো সমস্যা নয়। বাস্তবে তাদের অনুগত হতে কোনো সমস্যা নেই। দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য অনুগত থাকা মানে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তি। সমস্যা হলো, সরকার কেবল সম্ভাব্য অনুগতদেরই নিয়োগ দেবে, তবে নিয়োগ লাভে ইচ্ছুকদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।
সরকারের জন্য এটি বিষম সমস্যা। তাদের প্রয়োজন অনুগত আমলা, আর তাদের নিয়োগ করলে তারা পাবে অনুগত সেবক। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য অনুগতদের নিয়োগ করার জন্য তাদের প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক চাকরি সৃষ্টিকারী অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনৈতিক চিত্র হলো চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি কৌশলের। ফলে চাহিদার চেয়ে চাকরির সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
আর যেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ থাকা মানে সে নিয়োগ লাভে অযোগ্য, ফলে কোনো চাকরিপ্রার্থীই কোনোভাবেই বিরোধী দলের কার্যক্রমে জড়িত থাকবে না। এতে করে সরকারবিরোধী সম্ভাব্য তৎপরতার গতি শুরুতেই হ্রাস করে দেয়। তবে এটি এখন খুব বেশি মাত্রায় ভালো জিনিস হয়ে পড়েছে। এখন অত্যাধিক সংখ্যক লোক সরকারপন্থী হওয়ার অধিকার দাবি করছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ও আন্দোলনবিরোধী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। এদিকে পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বিক্ষোভ বরদাস্ত করা হবে না। মোবাইল ফোনে তোলা ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সশস্ত্র পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগুচ্ছে। এটি অনেককে সন্ত্রস্ত্র করেছে। আর চাকরিপ্রার্থীরা রাজনীতি জড়িত নয়, তাদের দাবি চাকরি।
সঙ্ঘাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণী?
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সরকার কোণঠাসা রয়েছে, তবে পরিস্থিতি আসলেই উত্তপ্ত। নববর্ষ শোভাযাত্রার আয়োজনে ভাংচুরের সাথে সহজেই ইসলামি গ্রুপগুলোর দিকে আঙুল তোলা যায়, কিন্তু এসব ঘটনায় ভিন্ন এজেন্ডা কিভাবে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তোলা যায় সেটিও দেখা যাচ্ছে। গত বছর হেফাজতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা নববর্ষের ‘মঙ্গল’ শোভাযাত্রার তীব্র সমালোচনা করেছিল।
মজার ব্যাপার হলো, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের মিত্র হতে যাচ্ছে। চলতি বছরের আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলাকারীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
তবে বিএনপি বলছেন যে ভিসি’র বাড়িতে হামলাকারীরা সরকারের লোক বা সমর্থক। এটা সত্যি যে দুটি হামলা একই সঙ্গে হওয়ায় কারো কারো মনে এই সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে একই রাতে বড় মাপের দুটি হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অপরাধীদের খুজে বের করে শাস্তি প্রদানের অঙ্গীকার করেছে সরকার।”
‘গতবছর হেফাজত বেশ সোচ্চার থাকলেও এ বছর তাদের মুখে রা নেই। ফলে এ বছর পহেলা বৈশাখের মিছিলে হামলার বিষয়টি কিছুটা আলোচনার বাইরে। তবে ষড়যন্ত্র তথ্যের তালাশে থাকেন তারা সরকারের হাত থাকার কথা বললেও এখন পর্যন্ত হেফাজতের সংশ্লিষ্টতাসহ তেমন কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত লোকজন বাংলা নববর্ষ শোভাযাত্রা চালাতে সংকল্প ব্যক্ত করলেও সংযত রাখতে চায়। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্বকারী হেফাজত ক্ষমতাসীন দলের ইতিবাচক মিত্রে পরিণত হয়েছে, তারা মোটামুটিভাবে নগর সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী ধারার ঐতিহ্যবাহী ‘বাঙালি’ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে।
হেফাজতের মিত্রতা লাভের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদকে সরকারি মর্যাদা দেওয়ায় মাদরাসার এই ধারার ছাত্ররা এখন আরো বেশি বেতনের চাকরির মূলধারায় যোগ দিতে অনেক বেশি তৈরি। অর্থাৎ তাদের সমর্থনের সাথেও চাকরির সম্পর্ক রয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে কয়েকটি ধারা আকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেছে এবং এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক। সরকারের প্রয়োজন সমর্থন ও আনুগত্যের, আর লোকজনের দরকার চাকরি। এই সমীকরণ সবার প্রয়োজন মেটাতে পারে বলে মনে হলেও সমস্যা হলো, চাকরির সুযোগ সীমিত। এখানেই অস্বস্তি, উত্তেজনা আর সম্ভাব্য সঙ্ঘাত।
সরকার বিভিন্ন অর্থনৈতিক অর্জনের তথ্য-উপাত্ত ও মাইলফলক ঘোষণা করলেও এর প্রভাব ভিন্ন। এতে অগ্রগতির চিত্র দেখা গেলেও তা সবার কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী বছরে এ ধরনের উপলব্ধির অতিরিক্ত কোনো মূল্য থাকুক বা না থাকুক, কিংবা ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হোক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভাবছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এই মুহূর্তে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী রয়েছে কিছুটা নিপীড়নে ও চাপের মুখে।
Posted ১২:৫৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১১ এপ্রিল ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta