কক্সবাংলা ডটকম(৩ সেপ্টেম্বর) ::‘যে মাটিতে জননীর ধর্ষণ হয়, সেই মাটিতে আজীবন খালি পায়েই চলব’-কথা রেখেছেন৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খালি পায়েই ছিলেন রমা চৌধুরী৷ সেই ৭১-এর বীরাঙ্গনা চলে গেলেন না ফেরার দেশে৷সোমবার ভোরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ৭৯ বছরের জীবন নিথর হল সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরীর৷
তিনি কখনো পায়ে স্যান্ডেল পরেননি, তাতে নাকি যে মাটিতে নিজের ছেলেদের শেষ স্থান হয়েছে সেই মাটিকে অসম্মান করা হয়। এতটাই ভালোবাসতেন দেশকে। তিনি একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী।
তিনি বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।’
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রমা চৌধুরী। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন রমা চৌধুরী।
সেদিন ছিলো ১৯৭১ সালের ১৩ মে। তিন শিশুসন্তান নিয়ে চট্টগ্রামের পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা রমা চৌধুরীদের বাড়িতে হানা দেয়। নিজের মা এবং দুই শিশুসন্তানের সামনে তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। বাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনাহারে, অর্ধাহারে দু’সন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে যায়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুবরণ করে সাগর। একই অসুখে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায় টগর।
দেশ স্বাধীন হলে শুরু হয় আরেক লাঞ্ছনা- সমাজের চোখে তিনি তখন এক ‘ধর্ষিতা নারী’। তৃতীয় ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এক জীবনে এতসব দুর্ঘটনার পরেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যেমন কোনো অর্থসহযোগিতা নেননি, তেমন কোনো ব্যক্তির কাছ থেকেও নিতে চাননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন এই সংগ্রামী নারী।
রমা চৌধুরীর মোট ২০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন সাহিত্যের প্রায় সব ধরনের শাখায়- সমালোচনা সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিকথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস গ্রন্থ, গল্প, উপন্যাস, লোক-সংস্কৃতিবিষয়ক গ্রন্থ, প্রবন্ধ এবং ছড়া। রমা চৌধুরী তার ৮টি বই উৎসর্গ করেছেন তার ৮টি বিড়ালকে। এমনই বিড়ালপ্রেমী ছিলেন তিনি।
রমা চৌধুরীর ছোটগল্প সংকলনের নাম ‘আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন’। স্মৃতিকথামূলক ২টি বই লিখেছেন রমা চৌধুরী। একটি ‘সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ অন্যটি ‘স্মৃতির বেদন অশ্রু ঝরায়’। এছাড়াও ‘একাত্তরের জননী’, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথামূলক উপন্যাস। ১৯৬১ সালে রমা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উত্তালক্ষণে তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন।
সামগ্রিক কবিতায় আমরা প্রতিবাদী রমা চৌধুরীর পাশাপাশি মানবিক ও প্রেমময়ী নারী রমা চৌধুরীকে পাই। একই সঙ্গে কিছু লেখায় পাওয়া যায় বিপ্লবী রমা চৌধুরীকেও। ‘মেয়েদের মা হওয়ার সুযোগ দাও’ শীর্ষক গদ্যে তিনি বলেছেন, বন্ধ্যা নারী যেমন আছে, বন্ধ্যা পুরুষও তেমন আছে। বন্ধ্যা নারীর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানের বাবা হতে পারছে। কিন্তু বন্ধ্যা স্বামীর স্ত্রীর জন্য সেই স্বাধীনতা কেন থাকবে না?
রমা চৌধুরীর কবিতার বই দুটো ‘স্বর্গে আমি যাব না’ ও ‘শহীদের জিজ্ঞাসা’। প্রকাশিত হয়েছে মাধুকরী থেকে।
‘১০০১ দিন যাপনের পদ্য’ শিরোনামে তার একটি ছড়াও বইও আছে।‘ নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলাদা করে গ্রন্থ লেখার পাশাপাশি পল্লীকবি জসীমউদদীন-এর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন ‘যে ছিল মাটির কাছাকাছি’ বইটি। জসীমউদদীন-এর ‘কবর’, ‘রাখালী’, ‘বালুচর’ ও ‘বেদের মেয়ে’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি তার মৌলিক চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বইয়ের একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হলো ‘বেদনার কবি’।
২০১৪ সালে অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা পান রমা চৌধুরী। রমা চৌধুরীর লেখা বইগুলোর তালিকা দেখে নিন নিচে।
প্রবন্ধ সংকলন
* রবীন্দ্র সাহিত্য ভৃত্য, * নজরুল প্রতিভার সন্ধানে, * সপ্তরশ্মি,* চট্টগ্রামের লোক সাহিত্যের জীবন দর্শন, * অপ্রিয় বচন, * যে ছিল মাটির কাছাকাছি, * ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ, * নির্বাচিত প্রবন্ধ
উপন্যাস
* একাত্তরের জননী, * লাখ টাকা, * হীরকাদুরীয়
কাব্যগ্রন্থ
* স্বর্গে আমি যাব না, * শহীদের জিজ্ঞাসা, * ১০০১ দিন যাপনের পদ্য
পত্র সংকলন
* নীল বেদনার খাম
স্মৃতিকথা
* সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, * স্মৃতির বেদন অশ্রু ঝরায়
গল্প সংকলন
* আগুন রাঙ্গা আগুন ঝরা * অশ্রুভেজা একটি দিন
Posted ৬:৫৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta