কক্সবাংলা ডটকম(২৯ আগস্ট) :: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য দেশটির সেনাপ্রধান ও আরও পাঁচ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করতেই হবে- এ কথা বলেছেন মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের চেয়ারপারসন। তিনি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে ২৭ আগস্ট জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন। রাখাইনে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা বলে প্রথমবারের মতো আখ্যা দিল জাতিসংঘ।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সর্বশেষ নিধনযজ্ঞ শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। তখন নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বাংলাদেশ সরকার তো বটেই, বিভিন্ন বেসরকারি পক্ষও তখন এই বিপন্ন-বিপর্যস্ত-সর্বহারাদের দিকে সহায়তার হাত প্রসারিত করেছিল। মানবিকতার দরজা খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সহানুভূতি, মমত্ববোধ বিশ্বব্যাপী আলোচনার নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল।
গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় লাভের এক বছর পূর্ণ হলো। রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি যখন বিভিন্নভাবে বিশ্বসভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তখন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর এক সময়ের প্রতিবাদী নেত্রী, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির একটি নতুন দাবি পুনরায় তাকে নিন্দার তীরে বিদ্ধ করেছে। তিনি দাবি করেছেন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে ৮১টি ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে!
এক সময়ের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চির নতুন দাবিটি করা হলো মিয়ানমার থেকে নতুন পর্যায়ে রোহিঙ্গা বিতাড়নের এক বছর পর, যা জলজ্যান্ত মিথ্যা বই কিছু নয়। আমাদের স্মরণে আছে, কফি আনান কমিশন তাদের প্রতিবেদন মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করার পরপরই রোহিঙ্গাদের ওপর পৈশাচিকতার মাত্রা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল। ৭ লাখ রোহিঙ্গার বাড়িঘরই তখন শুধু পুড়িয়ে দেওয়া হয়নি, একই সঙ্গে ঘটেছিল আরও বীভৎস কর্মকাণ্ড, যা সভ্যতা-মানবতার বড় ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
গত ২১ আগস্ট সু চিকে উদ্ৃব্দত করে সে দেশের স্টেট কাউন্সেলরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রচার করা হয়, ‘রাখাইন রাজ্যে টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য ড. কফি আনান কমিশনের ৮৮ সুপারিশের মধ্যে আমরা ৮১টিই বাস্তবায়ন করেছি।’
ধারণা করা যায় যে, তিনি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে এই মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশ পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হবে, মিয়ানমার সরকার এগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেনি। ওই সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন পর্যালোচনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার কি এ ব্যাপারে এই পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ নিয়েছে? এটি একটি মাত্র দৃষ্টান্ত। সু চির নতুন এই মিথ্যাচার সভ্য দুনিয়ার জন্য লজ্জার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে অবস্থান নতুন না হলেও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ৭ লাখ রোহিঙ্গা সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। তাদের কিছু অংশ পরে সেখানে ফেরত গেলেও আরও ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল।
সেই হিসাব-নিকাশে বলা যায়, এখন প্রায় ১০-১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র, সংস্থা ও সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে। রোহিঙ্গা নিধন, যা স্পষ্টতই গণহত্যা তা জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা স্বীকার করেছেন। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে বটে, কিন্তু বিষয়টি এখন আমাদের জন্য নানারকম সংকটও সৃষ্টি করেছে।
আমাদের এও মনে আছে, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের বিধ্বস্ত জনপদ রাখাইনে অং সান সু চি সফরে গিয়েছিলেন। তিনি যখন রাখাইনে তখনও বাংলাদেশ সীমান্তে নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গারা ভিড় করছিল। রাখাইন সফরে গিয়ে সু চি বলেছিলেন, ‘তোমরা ঝগড়া করো না।’ তার ওই মন্তব্য তখন সমালোচনার আরও খোরাক জুগিয়েছিল। কারণ রাখাইনে যা চলছিল তা ‘ঝগড়া’ নয়, স্পষ্টই জাতিগত নিপীড়ন। টানা সামরিক অভিযানে গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও, লুটতরাজসহ অমানবিক বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তখন বর্বরতার ধরনও পাল্টে গিয়েছিল। সেই সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছিল, এর ফলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে।
বিদ্যমান ওই পরিস্থিতিতে সু চি যখন রাখাইন সফর করছিলেন, তখন অনেকেই এই সু চির মাঝে সেই সু চিকে খুঁজছিলেন। সু চির অতীত-বর্তমান মিলিয়ে দেখলে হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। অং সান সু চি রক্ষণশীল বলে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। তিনি উদারনীতিরই মুখপাত্র ছিলেন। বিশ্ব তাকে চিনত গণতন্ত্রের এক মানসকন্যা হিসেবেই। তার লড়াইটা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। মিয়ানমারের জঙ্গি শাসকরা গণতন্ত্রের কণ্ঠ আক্ষরিক অর্থেই চেপে ধরেছিল, তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বিপদগ্রস্ত গণতন্ত্রের পক্ষে। তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে কারাগারে। এসব তো সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা।
সামরিক জান্তা তার বিরুদ্ধে নানা রকম মামলা দিয়েছিল। সু চির বিরুদ্ধে মামলাগুলোর সবই ছিল রাজনৈতিক। মামলা যারা করেছিল তারা নিজেরাই আবার বিচারক ছিল। কিন্তু সু চি ভয় পাননি। সামরিক শাসকদের জঙ্গিপনার সঙ্গে আপস করেননি। তারা তাকে বছরের পর বছর আটকে রেখেছে। সু চিকে লন্ডনে অসুস্থ স্বামীর কাছে যেতে তৎকালীন মিয়ানমার সরকার চাপ দিচ্ছিল এ কারণে যে, একবার দেশের বাইরে তাকে পাঠাতে পারলে আর দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সেদিন সু চি সেই ফাঁদে পা দেননি। দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। স্বামী মারা গেছেন লন্ডনেই। শেষ দেখাটা পর্যন্ত হয়নি। দুটি পুত্রসন্তান, তারাও বিদেশেই থাকে।
তার পরিবার ঐতিহ্যগতভাবেই রাজনৈতিক। পিতা অং সান আধুনিক বার্মা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৮ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বার্মার স্বাধীনতা অর্জন তার নেতৃত্বেই ঘটে। বার্মার আধুনিক সেনাবাহিনীর গঠনও তিনিই করেছেন। সু চির শিক্ষাজীবনও আলোকিত। পড়াশোনা শুরু করেন রেঙ্গুনের খ্রিষ্টান মিশনারিদের ইংরেজি স্কুলে। পরে মায়ের সঙ্গে দিল্লিতে গিয়ে পড়েছেন মিশনারিদেরই স্কুল ও কলেজে। সেখান থেকে চলে যান অক্সফোর্ডে। অক্সফোর্ডে বিএ পাস করেন তিনটি বিষয় নিয়ে।
এর পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএ করেন রাজনীতি বিষয়ে। কর্মজীবনের শুরু নিউইয়র্কে, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। আরও পরে এমফিল করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে। ১৯৯০ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারি ফেলো পদবি দিয়ে সম্মানিত করে। ভারতের সিমলাতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে তিনি গবেষণার কাজও করেছেন। সু চির কর্মযজ্ঞ ও খ্যাতির সীমানা আরও বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সেই সু চি ও আজকের সু চির মধ্যে তফাত কতটা বিদ্যমান বাস্তবতাই এর সাক্ষ্যবহ।
যে সু চি দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন, দুঃসহ নির্যাতন সত্য করেছেন সেই সু চি জাতিগত নিধনযজ্ঞের নীরব সমর্থক হবেন তা ভাবতেও আজ বিস্ময় লাগে। বৌদ্ধধর্ম হিংসায় বিশ্বাস করে না। সু চি মানবকল্যাণকামী নীতিরই অনুসারী ছিলেন। সেই মানুষটি স্বধর্মীদের একাংশকে উগ্র বর্ণবাদী আচরণে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি নিন্দিত হয়েছেন, হচ্ছেন এবং এ দাবিও বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে যে, তিনি যেন তার নোবেল পুরস্কারটি ফিরিয়ে দেন। সু চির নৈতিক স্খলন প্রশ্নের পর প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে।
বিশ্বের অনেক সম্পদশালী কিংবা ধনী রাষ্ট্র যখন দশ-বারো হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে অনীহা প্রকাশ করে সেখানে বাংলাদেশ ১০-১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, নিজের সম্পদ তাদের জন্য বরাদ্দ করেছে এবং সমগ্র বিশ্বকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সত্যি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে যে, বাংলাদেশ তার সীমিত সামর্থ্যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দীর্ঘদিন আশ্রয় দিতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতেই হবে। গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ বিবেকবান মানুষকে স্পর্শ না করে পারে না। তাদের এই বিক্ষোভ কেবল ঘরে ফেরার নয়, এটি মনে রাখতে হবে। তারা নৃশংসতার বিচার দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এই নৃশংসতার বিচারের যে দাবি উঠেছে তা খুবই সঙ্গত।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এখন মিয়ানমার এ ব্যাপারে আবার যেন অবস্থান পাল্টানোর ফন্দি আঁটছে। তাদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সবরকম ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পাশে আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের তরফে কূটনৈতিক ও মানবিক কার্যক্রম অধিকতর জোরদার করা জরুরি বলে মনে করি। মিয়ানমার দ্রুত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক। বোধোদয় ঘটুক অং সান সু চির। সভ্যতা-মানবতা আজকের যুগে এভাবে পরাজিত হতে পারে না।
হাসান আজিজুল হক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ
Posted ৭:০৬ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৯ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta