কক্সবাংলা ডটকম(৫ জুলাই) :: দেশবাসী ও পুরোবিশ্বের সমগ্র সচেতন নাগরিক সম্যক অবগত আছেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)’ নামক বিদ্রোহী সংগঠনটি মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালানোর কথিত অভিযোগে রাখাইন রাজ্যে বর্বরতম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিষ্পন্ন অব্যাহত থাকে।
নৃশংস গণহত্যা-চরম নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ ও প্রাণ রক্ষায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট প্রায় বার লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। নিষ্ঠুর এই দৃশ্যাদৃশ্য ধরিত্রীর সকল মানবিক হৃদয়ে তৈরি করে করুণ আর্তনাদ। মানবতার জননী শেখ হাসিনার নির্দেশে সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফে এইসব রোহিঙ্গাকে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সহযোগী সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের সার্বিক বিষয় নিশ্চিত করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার।
উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার কারণে জাতিসংঘের ভূমিকার পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বিরোধীতা করে আসছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হলেও বাস্তবতায় এর কোন ইতিবাচক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়নি। অধিকন্তু বৈশ্বিক আধিপত্যবাদী কদর্য ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন সঙ্কটকে ক্রমশ দীর্ঘায়িত ও জটিল করে তুলেছে।
ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দুটি মামলা চলমান আছে। আদালতের রায় অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা থেকে রক্ষার নির্দেশ প্রদান করা হলেও মিয়ানমার সরকার এই রায়কে শুধু অবজ্ঞা নয়; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা ধরনের প্রভাববলয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সঙ্কট উত্তরণে কোন ধরনের পদক্ষেপকেই বিবেচনায় নিতে আগ্রহী নয়।
ইতিমধ্যে চার বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকরণে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরোপিত পাঁচটি শর্তকে মোটেও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যৌক্তিক শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, কেড়ে নেওয়া ভিটেমাটি ফেরত, জানমালের নিরাপত্তা, গণহত্যা-ধর্ষণসহ নির্যাতনে জড়িত সেনাবাহিনী-উগ্রপন্থী মগদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার, ২০১২ সালে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে আশ্রয়শিবিরে রাখা ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে নিজেদের বাসস্থান ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিশাল আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নানামুখী অপকর্ম কক্সবাজারসহ পুরো অঞ্চলকে দুর্বিষহ ও বিপর্যস্ত করে চলেছে। স্থানীয় শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ, মাদক চোরাচালান, বেচা-কেনা ও সেবন, অস্ত্রের ব্যবসা ও ব্যবহার, ধর্ষণ, অসামাজিক কাজ, মানবপাচার, হত্যা-সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াসহ এদের অসহনীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে যারপরনাই হিমসিম খেতে হচ্ছে।
১৬ জুন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘মানবিক বিবেচনায় আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি; তবে এই সঙ্কটটির সমাধান নিহিত রয়েছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপর, যা গত চার বছরে সম্ভব হয়নি। আমরা চাই প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘ স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করুক।’ কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দীর্ঘসময় ধরে অবস্থানের ফলে ঐ এলাকায় বসবাসরত মূল জনগোষ্ঠীর উপর এর বিরূপ প্রভাবও তিনি তুলে ধরেন।
ভাসানচর প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ যাতে ভাসানচরে মানবিক সহায়তা প্রদান করে।’ উক্ত বৈঠকে বার্গনার বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এবং অচিরেই যাতে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করা যায়, সেজন্য জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রসহ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সব অংশীজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।’
জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন ও স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরে গড়ে বছরে ৩০ হাজার ৪ শত ৩৮ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। বর্তমানে নবজাতক শিশুর সংখ্যা প্রায় সোয়া লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে। অতিসম্প্রতি কক্সবাজারের উপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে ভাসানচরে প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত নান্দনিক পরিবেশে স্থাপিত আবাসনে রোহিঙ্গাদের প্রভূত প্রেষণায় স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, কৃষি অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সন্তানদের লেখাপড়া-খেলাধুলা ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা এবং মসজিদসহ নিরাপদ জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ উপভোগ করে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা বিপুল সন্তুষ্টি প্রকাশে অন্যদেরও ভাসানচরে যাওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহীশীল করে তুলছে।
এমনও বক্তব্য এসেছে; কুতুপালং বা অন্যান্য ক্যাম্পে থাকাটা ছিল নরকের মতো। বিশাল পরিমানে সমতল ভূমি, নিরাপত্তা, পানি, বাথরুমসহ বসবাসের অনুপম ব্যবস্থা তাদের অধিকমাত্রায় প্রণোদিত করছে। ইতিমধ্যে ভাসানচরে প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে এবং স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক এমন প্রায় ২৩ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাওয়া গেছে।
জনশ্রুতি মতে; জাতিসংঘ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন-হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-আন্তর্জাতিক অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন তথাকথিত উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অসৎ উদ্দেশ্য সাধন-অদৃশ্য এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই স্থানান্তরের বিরোধীতা ক্রমাগতভাবে কক্সবাজারসহ দেশবাসীকে অপরিমেয় হতাশাগ্রস্ত করছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মূখপাত্র স্টিভেন গোজারিচ’র স্থানান্তরকে অনুচিত বলা মোটেও সমর্থণযোগ্য নয়। বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার কূটচালও মানবাধিকার লংঘন এবং দেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। দেশীয় এনজিওগুলো তাদের ব্যক্তিস্বার্থে অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনে কুৎসিত প্রচারণা ও সমস্যাকে জিইয়ে রাখার বিষয়টি অনতিবিলম্বে তাৎপর্যপূর্ণ তদন্তের দাবী রাখে।
নিরপেক্ষ বস্তু-সত্যনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নিগূঢ় অনুসন্ধানে এসব সংস্থার দূরভিসন্ধিমূলক চক্রান্ত প্রমাণিত হলে দেশীয় সংস্থাসমূহের নিবন্ধন বাতিল ও অর্জিত অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনযাপনে বিনিয়োগ হওয়া উচিত বলে বিজ্ঞ জনেরা অভিমত পোষণ করেন। কোনভাবেই আত্তীকরণ নয় বা স্থায়ীভাবে বসবাসের সম্ভাবনাকে নিরন্তর অগ্রাহ্য করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই চাপ প্রয়োগে বিশ্ব সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশিত। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে বাচনিক-মানবিক এবং রাখাইন রাজ্যে বেশকিছু বাড়ি নির্মাণ করা সত্ত্বেও এই প্রত্যাবাসন পরিপূর্ণতায় চীনের প্রভাববলয়ে থাকা মিয়নমারের উপর চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের মাত্রা বহুলাংশে গভীরতম হচ্ছে।
এটি সকলেরই জানা যে, মিয়ানমারে চীনের বিশাল স্বার্থ জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্কের চেয়েও ভূ-রাজনীতির গুরুত্বে চীনের সাথে মিয়ানমারের প্রগাঢ় সম্পর্ক এবং বিশ্বপরিমন্ডলে সাম্প্রতিক চীনের প্রভাব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কট দ্রুততর সময়ের মধ্যে নিরসন সুদূরপরাহত মনে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ) কর্তৃক যৌথভাবে গত বছর ১৮ নভেম্বর চতুর্থ বারের মতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
‘দ্য সিচুয়েশন অব হিউম্যান রাইটস অব দ্য রোহিঙ্গা মুসলিমস অ্যান্ড আদার মাইনরিটিজ ইন মিয়ানমার’ শিরোনামে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক কদর্য মানবাধিকার লংঘনের তীব্র সমালোচনা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিস্ময়কর ব্যাপরটি হচ্ছে এই, ১৩২ ভোটের সমর্থণে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলেও চীন-রাশিয়াসহ ৯টি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ভারত, জাপান, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো অত্যন্ত বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো ভোট না দেওয়ার তালিকায় রয়েছে। এই দৃশ্যপট প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অতিশয় দুর্বল করে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকাকেই অতিমাত্রায় সবল করার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।
প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ্য যে, নিকট অতীতে মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবারের বক্তব্য তরিত্র প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মানবিক সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। রোহিঙ্গা সঙ্কট কেন্দ্রিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে এর প্রভাব থেকে চীন- ভারত কেউ বাদ যাবে না। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের জন্য সেফ জোন প্রতিষ্ঠার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব আবারও অনিবার্যভাবে সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার পক্ষ থেকে যথাক্রমে মিয়ানমারে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত না হওয়ার জন্য মিয়ানমারের উপর অব্যাহত চাপ প্রয়োগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের আরো জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত ইত্যাদি চন্দ্রোদয় বক্তব্যের কার্যকারিতা অসার দীপনেই ধর্তব্য। চলতি বছরের প্রথম জানুয়ারি থেকে ভারত নিরাপত্তা পরিষদে বসেছে। এতকাল কয়েকটি স্থায়ী সদস্যের আপত্তির কারণে কোন প্রস্তাব পাশ করানো যায়নি। ভারতের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যূতে নিরাপত্তা পরিষদে সম্ভাব্য প্রস্তাব পাশ করানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের দিয়মান প্রত্যাশা ইতিমধ্যে ভারত সরকারের নিকট জ্ঞাপিত হয়েছে।
উইকিপিড়িয়া বা মুক্ত বিশ্বকোষ উৎসসূত্রে জানা যায়, ঐতিহাসিকভাবে আরাকানী-ভারতীয় রোহিঙ্গা হলো রাখাইন রাজ্যের রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। এদের সমাজ-ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের ধারায় আরাকানে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসতি স্থাপন করেছিল। ম্রক-ইউ রাজ্যের সম্রাট নারামেখলা’র (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালে বাঙালিদের আরাকানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের পরলোকগমনের পরে রাজা নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। ১৭৮০ সালে চরম মুসলিম বিদ্বেষী বর্মি রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নির্বিচারে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়।
১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্বশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক লক্ষ মুসলিম নির্দয় হত্যার শিকার হয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জেনারেল অং সানকে কয়েক মাসের মধ্যে মন্ত্রী পরিষদের সকল সদস্যসহ জঘন্য হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সেনাবাহিনী রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করে। অদ্যবধি এই সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত হয়ে অনৈতিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে নোবেল বিজয়ী কথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেও সেনা বাহিনীর সাথে সমঝোতায় সরকার গঠন করতে হয়েছিল।
আশাজাগানীয়া উজ্জ্বীবন ছিল, সু চি’র দল এবং আপেক্ষিক রাষ্ট্র শাসনের অধিকারী হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাঁর অবদানকে অত্যুজ্জ্বল করবে। বাস্তব অনুভবে এটি মারাত্মক নিরাশারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের ক্রমবর্ধমান হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আশির দশকে জেনারেল নে উইন’র শাসনকালে আদমশুমারীর প্রাক্কালে রোহিঙ্গাদের বিদেশী ঘোষণা করে কঠিন নিপীড়ন চলমান থাকে।
১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল-ভোটাধিকার-সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার বঞ্চিত করে সাধারণ বসবাসকারী হিসেবে অনুমতি ছাড়া মিয়ানমারের অন্য প্রদেশেও তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং ধীরে ধীরে বৌদ্ধদের আধিক্য তাদের সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে পরিণত করে। প্রচলিত সত্য যে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাদের উপর নির্যাতন শুরু হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইন প্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে মিয়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অকস্মাৎ মিয়ানমার সরকারের বিরূপ মনোভাবের বহি:প্রকাশে জাতীয় জনগোষ্ঠী নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়।
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে মিয়ানমারের অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের ঘৃণা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আড়ালে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যা-অবৈধ গ্রেফতার-নির্যাতন-ধর্ষণ-অপব্যবহার ও জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্যবাধকতা রোহিঙ্গাদের উপর এই নির্যাতন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মোদ্দাকথা হচ্ছে; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘সেইফ জোন নির্মাণ এবং পূর্ণ মানবিক মর্যাদা-নিরাপত্তা-অধিকারের’ ভিত্তিতে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই সমস্যার টেকসই এবং একমাত্র স্থায়ী সমাধান। এর কোন বিকল্প বা অযৌক্তিক পরিকল্পনা সঙ্কট পরিহারে নুন্যতম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অসমর্থিত নানা সামাজিক প্রতিবেদনে জানা যায়, এই নিপীড়িত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জঙ্গীগোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় ইত্যবসরে জঙ্গী সংগঠনগুলোর বড় অংশ হিসেবে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে।
অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নাগরিক সনদ ও পাসপোর্ট তৈরি এবং দেশের নানা অঞ্চলে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতাকে বেগবান করছে। অভিশপ্ত ভূ-রাজনীতির অপকৌশলের ঘৃণ্য আবরণে কথিত প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত না হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক এবং দ্বিপক্ষীয় প্রয়োগিক আলোচনা এবং জাতিসংঘসহ বহির্বিশ্বে নানামুখী কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার সমীকরণ মূর্তমান করা না গেলে এই সঙ্কট বাংলাদেশকে কঠিন ঝুঁকির মুখোমুখি করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কের অর্থবহ-সার্থক রূপায়নে অচিরেই ভারত এবং চীনের দৃশ্যমান-ক্ষোদিত-পরিগ্রহ আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মিয়ানমার সরকারের উপর কঠিন চাপ প্রয়োগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কট নিরসন করতে পারবে – নি:সন্দেহে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
লেখক: ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Posted ১:১৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ জুলাই ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta