কক্সবাংলা ডটকম(২৬ মার্চ) :: ভারত আর চীনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কে? তারা বলতে পারেন, ভারত বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দেশ। একাত্তরে তারা আমাদের পক্ষে ছিল। দুই লাখ মানুষকে তারা আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি অস্ত্র দিয়ে, সৈন্য দিয়ে পর্যন্ত সাহায্য করেছে। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়। অতএব এই দুই দেশের মধ্যে ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু এতে সংশয়ের কী আছে!এ কথা সবারই জানা যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বতোভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরু হলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্ত সীমান্ত খুলে দেয়, যাতে নির্যাতিত বাঙালিরা তাদের দেশে আশ্রয় নিতে পারে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন এবং তার প্রচেষ্টাতেই তৎকালীন বৃহৎ শক্তিধর দেশ রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গাটি দখল করে নেয় ভারত ও ভারতের জনগণ।
অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শুধু যে সমর্থন দেয়নি তা নয়, তারা সে সময় প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের আগে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। তবে পঁচাত্তরের পরে তারা বিভিন্ন সময় নানান সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সেতু চীনের সাহায্যে গড়ে উঠতে দেখেছে বাংলাদেশে জনগণ। বুড়িগঙ্গার ওপর প্রথম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু থেকে শুরু করে কচা নদীতে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া তাদের কাছে চীনকে বাংলাদেশের ‘বড় বন্ধু’ হিসেবে ভাবতে সহায়তা করে।সাম্প্রতিক শুল্ক ছাড়ের বিষয়টিতে অনেকেই তাদেরকে বড় বন্ধু বলে ভাবতে শেখায়। বিভিন্ন মহল থেকে যদিও বলা হয়, সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে চীন। আর সেই সূত্রেই ভারতের আশপাশের দেশগুলোর প্রতি তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন।
আজ দীর্ঘ ৫০ বছর পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি বন্ধুত্ব ও সংযুক্ততার ঐতিহাসিক বন্ধনের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের বর্তমান মেয়াদকালে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একের পর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। বাংলাদেশ-ভারতের এই সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সভ্যতার ঐতিহ্যগত অংশীদারিত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ফেনী নদীর ওপর স্থাপিত বহুল প্রতীক্ষিত মৈত্রী সেতু গত ৯ মার্চ, ২০২১ তারিখে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে উদ্বোধনের ঘটনা দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যেকার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের সাম্প্রতিক উদাহরণ।
তাই ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন বাড়তি তাৎপর্য বহন করে। মোদির আগমনের বিরোধিতা আরেক সাম্প্রদায়িক উসকানি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে এক কথায় মুজিব-ইন্দিরার হাত ধরে দুই দেশের উষ্ণ আন্তরিক বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের যে শুভসূচনা ঘটেছিল আজ ৫০ বছর পরে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সে সুসম্পর্ক বহাল রয়েছে। ভারত আমাদের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তে লেখা ইতিহাসে নিবিড় পরীক্ষিত বন্ধু।
বাংলাদেশের মানুষের চোখ এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে। কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বর্তমানে নতুন দিগন্ত ছুঁয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি বাংলাদেশে বিএনপি-জামাত জমানাকালে পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে এই মুহূর্তে দু’দেশের সরকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সুদৃঢ় আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ আস্থার কথা দুই দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কথায় বারে বারে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের নিকটতম প্রতিবেশি দেশ।
তদুপরি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত সর্বতো সহয়তা দিয়েছে। তাই ভারত নিয়ে বাংলাদেশের দেশের মানুষের আগ্রহটাও বেশি। ভারতে টানা দুইবারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈশ্বিক করোনা-১৯’কে তুড়ি মেরে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফর করবেন। যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মোদি তাঁর বক্তব্যে বারে বারে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গাড় করার কথা জোর দিয়েছেন। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে অন্য পড়শিদের চেয়ে সর্বাগ্রে।
এর অন্যতম উদাহরণ কোভিড-১৯ টিকা অন্য দেশে পাঠানোর আগেই বাংলাদেশকে দিয়েছেন মোদি সরকার। সেরাম থেকে ক্রয় বাবদ তিন কোটি ভ্যাকসিন পাঠানের আগেই ভারত শুভেচ্ছা হিসেবে দিয়েছে ২০ লক্ষ ভ্যাকসিন। অর্থাৎ মোদি বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁর কথার সঙ্গে তাঁর কাজের মিল রেখেছেন।
গত ১৭ মার্চ বাংলাদেশের জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মদিনে বাংলায় টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সকল ভারতীয় নাগরিকের কাছে একজন বীর। মোদি আরও বলেন, ‘মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার রক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। তিনি সকল ভারতীয় নাগরিকের কাছেও একজন বীর। একই সঙ্গে মোদি বলেন, ‘ ঐতিহাসিক মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সফর করতে পারাটা আমার জন্য সত্যিই সম্মানের বিষয়।
এরপর ২৫ মার্চ এক ভিডিও বার্তায় নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আগামীকাল জাতীয় দিবস উদযাপনে অংশ নেওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছি, যাতে শততম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও স্মরণ করা হবে। গত শতাব্দীর অন্যতম শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু, যার জীবন ও আদর্শ এখনও লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।’ওই বিবৃতিতে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যও অধীর অপেক্ষার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
মোদি বলেন, ‘করোনা মহামারির এই সময়ে এমন এক প্রতিবেশী বন্ধু দেশে সফর করতে পেরে আমি আনন্দিত, যার সঙ্গে ভারতের গভীর সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বিদ্যমান।’সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জে মন্দির পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে মোদি বলেন, ‘সাতক্ষীরায় পৌরাণিক যশোরেশ্বরী মন্দিরে মা-কালীর প্রতিও পূজা দিতে চাই আমি। বিশেষ করে ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গেও মিথস্ক্রিয়া করতে চাই আমি, যেখানে শ্রী হরিচরণ ঠাকুর পবিত্র বাণী প্রচার করেছিলেন।
’ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল বৈঠকের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ-আলোচনা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে।’ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাপ্নিক নেতৃত্বে তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশকে সাধুবাদ জানানোয় আমার সফর সীমাবদ্ধ থাকবে না; এর সঙ্গে এই অর্জনে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও থাকবে।’এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও সংহতির বার্তাও সফরে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির এটি দ্বিতীয় সফর। গত বছরের মার্চ মাসে মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর আসার কথা থাকলেও কভিড-১৯ মহামারির কারণে স্থগিত হয় সেই সফর। নতুন বাস্তবতায় এক বছর পর কভিড মহামারির মধ্যেই ঢাকা সফরে আসছেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তিতে মোদির এ সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
জানা গেছে, মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির সফর উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দেয়।২৬ মার্চ তিনটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদির এই সফর। তিনি ২৬ মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। একইসঙ্গে উভয় দেশের মধ্যে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। করোনা মহামারির মধ্যে এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। করোনার কারণে এর মধ্যে তিনি অন্য কোনো দেশে সফর করেননি। মোদির ঢাকায় আগমন বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত আবেগের।
ভারত-বাংলাদেশের এমনতরো বন্ধুত্বের বাতাবরণ আর মোদির সফর উভয়দেশ ও জনগণ সর্বোচ্চ সুফল ভোগ করতে পারবেন বলে সবাই আশাবাদী। বিশ্বের সব প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে একটা সমস্যা থাকেই। এর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতও ব্যতিক্রম ছিল না। তবে এ সমস্যা উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করে নিয়েছেন।
অপরদিকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর জলবণ্টনের বিষয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়েই দুই দেশের মধ্যে দৃঢ় ভিত রচিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে চুক্তি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না। বলা বাহুল্য, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাতাবরণ তৈরি হয়। কয়েকদশক ধরে চলা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে বৈরিতা দূর করে শেখ হাসিনা জনসংহতির সঙ্গে ‘শান্তিচুক্তি’ করেন। সমাধান করা হয়েছে স্থল সীমানা-সহ সমুদ্র সীমানাও। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বর্ণালি ময়ূরপুচ্ছের ওপর আরো কিছু সোনালি পালক জুড়ে দেন। করোনার কারণে নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনার বৈঠকটি ভার্চুয়ালি হলেও দুই নেতার চোখ ও মুখের ভাষায় বোঝাপড়ার মাত্রাটা কতখানি উঁচু সেটা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি আন্তরিকতার উষ্ণ বাতাসে উভয় দেশের জনমানুষ মুগ্ধ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি পুনরায় উচ্চারণ করেছেন, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ আগের মতো আগামী দিনেও সব কিছুতে এক নম্বর ও সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের মনে সব সময় একটা ভীতি সৃষ্টি করে রাখতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তান গোয়েবলস –এর কায়দায় ভারত বিরোধীতা চালিয়ে যেতো । তারা বাঙালিদের বোঝাত যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। পাকিস্তানের ওই ডাহা মিথ্যা কথাটা প্রমাণিত হল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের মানুষের মহাদুর্দিন। বাঙালিদের কঠোর হাতে দমন করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকেই হত্যা মিশনে নেমে পড়ে। ওই রাতেই ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ আখ্যা দিয়ে নিরস্ত্র-নিরীহ এক এক লাখ বাঙালির প্রাণ কেড়ে নেয় খান সেনা। এরপর পাকিস্তান পুরো নয় মাস বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। আর পাঁচ লক্ষ মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম কাণ্ডের অন্যতম বলে গণ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলেছে- ভারত সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে দলে দলে বাঙালিরা ভারতে পাড়ি জমায়। ভারত শুধু এক কোটি মানুষকে আশ্রয় নয়- তাঁদের খাদ্য-বস্ত্র ও মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিয়ে সর্বতো সহায়তা করে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পাক সেনাদের হটাতে ও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভারত ও বাংলাদেশ ‘মিত্রবাহিনী’ গঠন করে। এরফলে পাকিস্তানের পরাজয় অতিদ্রুত ও নিশ্চিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনগণ সেসময়ে দেওয়া ভারতের সমর্থন ও সাহায্যের কথা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পররর্তীকালে দেশ পুণ:গঠনেও ভারত সর্বপ্রকার সাহায্য দেয়।
অবশ্য ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তান সমর্থক গোষ্ঠী। তারাও পাকিস্তানের মতো ভারত বিরোধীতায় সরব হয়। ফের দু’দেশের সম্পর্ক চোরাগলিতে ঢুকে পড়ে। তবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০২ সাল অবধি ক্ষমতায় থাকার ফলে দু’দেশের মধ্যে ফের আস্থা সৃষ্টি হয়। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামাত শাসনামলে ফের ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লীগ সরকার গঠনের পর ফের দু’দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা টানা তিন দফা (১৫ বছর মেয়াদে) সরকারে থাকায় অতীতের সকল বৈরিতা দূর হয়ে উভয় দেশের মধ্যে সর্বকালের সর্বোচ্চ আত্মীক সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে।
২৬ মার্চ দু’দিনের সফরে বাংলাদেশ সফরের আগে মোদি ২০১৪ সালে দেশের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেই এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুনে তিনদিন বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছেন। বিএনপি-জামাতের শাসনকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ উত্থান ঘটে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের ফলে তা শক্ত হাতে দমন করায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে। যা ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করে। কেননা ভারতের সেভেন সিস্টার্সে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছিল তা থিতিয়ে যায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ ঘাটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক দুর্লভ সুযোগ লাভ করে। এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে করিডর বা ট্রানজিটের সুবিধা লাভও ভারতের অনুকূলে চলে যায়। বাংলাদেশ সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। এ ধরনের উদ্যোগ সন্দেহাতীতভাবে ভারতীয় সরকারি পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একধরনের বিশ্বাসের ওপর দাঁড় করাতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে অবশ্য ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির প্রত্যাশাকেও উৎসাহিত করে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সন্ত্রাস বিরোধী কাজ এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রানজিটের সুবিধা এবং ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধাদানে রাজি হয় সীমান্ত সমস্যা সমাধানেও নেতারা রাজি হন। বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়নেও তাঁরা নতুন ক্ষেত্র নিয়ে মনোযোগী হন। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি এবং ভারতের এক মিলিয়ন ডলারের ঋণদান অন্যতম। এরপর দুই পক্ষ কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের মোটামুটি একটি ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হয়। তবে এটা ঠিক ভারত ও বাংলাদেশ আজ একে অপরের জন্য অপরিহার্য। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারত অনেকগুলো ইতিবাচক সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই গণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রকেই তারা তাদের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভারতের গণতন্ত্র যেমন গভীরতা অর্জন করেছে, তেমনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রও প্রমাণ করেছে যে সে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়েও বরং সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সফলতা কামনা করে, যা উভয় দেশের জন্য উন্নয়ন, অগ্রগতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনবে।
Posted ১:৪৩ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২৬ মার্চ ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta