রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

সংস্কৃতি, সমাজসেবক ও একজন পত্নীপ্রাণ তাপস হোড়

মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩
97 ভিউ
সংস্কৃতি, সমাজসেবক ও একজন পত্নীপ্রাণ তাপস হোড়

কক্সবাংলা ডটকম(৫ জুন) :: পঞ্চভূতে লীন হয়ে যাওয়া প্রিয়তমা স্ত্রীর চিরপ্রস্থানের দুই সপ্তাহ পেরিয়েছে। বিয়োগ বেদনার পর্বতসম পাথর সরিয়ে শোকাতুর মনকে শান্ত করে স্ত্রীর পারলৌকিক আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক প্রবীণ।

৩৮ বছরের যাপিত দাম্পত্য জীবনে এমন একাকীত্ব হয়তো ভুলেও কল্পনা করেননি তাপস হোড়। দেশ ও সমাজের সব দায়িত্ব আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে জীবনভর কেবল ছুটেই চলেছেন। বীর চট্টলার বিপ্লব চেতনায় স্নাত হয়ে বেড়ে উঠা একজন তাপস হোড় মজ্জাগত চেতনাকে সমুন্নত রাখতেই জীবনের সবটুকু সময় পার করে দিলেন। বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন কিংবা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্যকে জীবনের ব্রত করলেও নিজের ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়ে ছিলেন দারুণ উদাসীন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যালোক আলোকিত করে এসেছিলেন একজন।

যিনি পরিবারের কর্তব্যকে সামলে একজন তাপস হোড়কে সত্যিকারের নিষ্ঠাবান সংস্কৃতি ও সমাজসেবক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেন, কিন্তু থেকে যান নেপথ্যে। দুই সন্তান ও স্বামীর প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পূর্ণতার দিনে তিনি পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে। তাপস হোড়-কৃষ্ণা হোড় দম্পতির প্রায় চার দশকের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটলেও ভালোবাসার যে আখ্যান রয়ে গেল নীরবে তা বোধহয় এখনকার সমাজ জীবনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ এর সভাপতি এবং সঙ্গীত পরিষদ চট্টগ্রাম ও মাস্টারদা সূর্যসেন স্মৃতিরক্ষা কমিটির সম্পাদক তাপস হোড়ের স্ত্রী চট্টগ্রাম ওয়াসার অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী কৃষ্ণা হোড় গেল ২৫ এপ্রিল ২০২৩ প্রয়াত হন। পার্থিব জীবনে এ হয়তো এক অমোঘ নিয়তিই। কিন্তু সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে পারিবারিক বা বৈবাহিক জীবনের যে দৃশ্যপট আমরা দেখতে পাই-সেখানে সহমর্মিতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সর্বোপরি এক নিবিড় বন্ধনের ঐতিহ্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বা লোকাচারে পারিবারিক ঐতিহ্যে আত্মকেন্দ্রিকতার কথা শোনা গেলেও বিশ্বায়নের প্রভাবে আজ বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি ও জীবনবোধ রীতিমতো বিপন্ন।

May be an image of 1 person and smiling

একীভূত পরিবারে দাদা-দাদী, কাকা-জ্যাঠার মতো মধূর সম্পর্কগুলো তো দূরের বিষয়; খোদ স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর, বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কও আজ ফিকে হয়ে গেছে। এক ঘরে থেকেও যেন কেউ কারোর খবর রাখেন না! ফলশ্রুতিতে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে সামাজিক সম্প্রীতির ঐতিহ্যিক পরম্পরা আজ সুদূর পরাহত। বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা এখন যেন এক নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে-সমাজে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে এই প্রবণতা সবেচেয়ে বেশি। এমন বাস্তবতার মাঝে তাপস-কৃষ্ণা দম্পতির প্রীতিময় সম্পর্কের আখ্যান আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

আমরা দূর থেকে যতোখানি জানি এই দম্পতি সম্পর্কে; তাদের কাছের স্বজনদের কল্যাণে আরও অনেক বেশি জানতে পারি। পারস্পারিক আস্থা ও ভালোবাসার এক মধুর সম্পর্কে তাপস হোড় ও কৃষ্ণা দম্পতি আড়াই দশক পেরিয়েছে ততোদিনে। দুই প্রিয় পুত্র অনীক ও অভিক হোড়ও বড় হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার চাকুরি শেষ হতে আর মাত্র ৪ বছর বাকী। পেশাগত দায়িত্বের পাট চুকিয়ে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আরও সময় দেওয়ার প্রতীক্ষায় দিন গুণছেন কৃষ্ণা হোড়।

পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক ব্যাধি কৃষ্ণা দেবীর ভাগ্যাকাশে বিষাদের ছায়া ফেলে। ২০১২ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ডিমেনশিয়া বা চিত্তভ্রংশ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক্রমেই দুর্বল হতে থাকেন তিনি। অসুস্থতাকে সঙ্গী করেই ২০১৬ সালে অবসর যান কৃষ্ণা হোড়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নন্দীরহাট গ্রামের সন্তোষ মিত্র-রতœা মিত্রের জ্যেষ্ঠ কন্যা বৈবাহিক জীবনে সার্থকভাবে গৃহিণী-জননীর দায়িত্ব পালন করে চাকুরি জীবনে অর্পিত দায়িত্বও পালন করেন সমান নিষ্ঠায়। সংগ্রামমুখর জীবনে অখ- অবসরের কাছাকাছি এসে অবসরকে স্পর্শও করলেন বটে, তবে অবচেতনে।

হোড় পরিবারের এই অপ্রত্যাশিত দুর্ভাগ্যবরণের ঘটনায় আমূল বদলে যান তাপস হোড়। রোগশয্যায় প্রিয়তমা স্ত্রীর শশ্রুষার মধ্য দিয়ে তাঁর ভেতরে এক নতুন সত্ত্বার নির্মাণ হয়। নিরন্তর ছুটে চলা তাপস হোড় যেন অনেকটাই স্থির হয়ে যান। জরুরি বেরুনোর প্রয়োজন হলেও সন্ধ্যার মধ্যেই তাঁর ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা। আমরা স্মরণ করতে পারি, প্রমীলা নজরুল ইসলাম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলে-তাঁর জন্য সুস্থাবস্থায় জীবনের শেষ দিনগুলিতে কী ব্যাকুলতাই দেখা গিয়েছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে। গ্রামোফোন রেকর্ড এর রুম থেকে সহশিল্পীদের দ্রুত বিদায় জানিয়ে বোহেমিয়ান কবিকে বলতে শোনা যেত, ‘তোমাদের বৌদি অসুস্থ, আমাকে এবার ঘরে যেতে হবে।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপস হোড়কেও শয্যাশায়ী সংজ্ঞাহীন স্ত্রীর জন্য সারাক্ষণ ব্যাকুল থাকতে দেখেছি। ২০১২ সালে অসুস্থ হওয়া কৃষ্ণা হোড় ২০২০ সালের দিকে এসে পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন হয়ে শয্যা নেন। গেল ৩টি বছর কারোর ওপর নির্ভর না করে স্ত্রীকে খাবার খাওয়ানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ ঘরের সব দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নেন তিনি। স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সমাজে চালু রয়েছে, তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক দৃষ্টান্ত গড়ে সংস্কৃতিবান তাপস হোড় ‘মানুষ তাপস হোড়’ হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেন।

সংগঠনের কাজে মাঝে মধ্যেই চট্টগ্রাম থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে হতো তাপস হোড়কে। প্রত্যুষে যাত্রা করে দুপুর নাগাদ ঢাকায় পৌছে প্রবীণ এই মানুষটি বিকেল নাগাদ কাজ শেষ করে ফের চট্টগ্রামে উদ্দেশ্যে রওনা করে রাত ১০টা নাগাদ পৌছাতেন কেবল অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকবার জন্য। বার্ধক্যের ক্লান্তি কিংবা আমন্ত্রণকর্তাদের সব অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ঘরে ফিরে যেতেন-যেমন করে একসময় কৃষ্ণা দেবী অফিস শেষ করে সংসার আর সন্তানদের সামলাতে ঘরে ফিরতেন। নিয়তির এমন পরিণতিকে আপন করে নিয়েছিলেন তাপস হোড়। তাকে দেখে আমাদের আবহমান সমাজের দায়িত্ববান পুরুষদের প্রতিচ্ছবিই কেবল ভেসে উঠে। আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে সমুন্নত রাখতেই এমন দৃষ্টান্ত জরুরি, যা একজন তাপস হোড় সৃষ্টি করেছেন।

স্ত্রী বিয়োগের ১৪তম দিবসে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় তাপস দা’র কাছে ফোনে জানতে চেয়েছিলাম কেমন আছেন এখন? খানিকটা নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘একটা পিছুটান ছিল, ঘরে ফিরতে হবে… তাড়াতাড়ি। ছেলেরা দেশের বাইরে থাকলেও জানতো, অজ্ঞান হলেও মা আছেন। আজ তাদের মা নেই, সবাই দেশে ফিরেছেন …তবু সেই পিছুটানটাই যেন ভালো ছিল’-বাষ্পরুদ্ধ তাপস দা আর কিছু বলতে পারেননি।

আমরা একজন কৃষ্ণা দেবীর প্রয়াণে তাঁর স্বজনদের গভীর মর্মবেদনায় সমব্যথী। একজন তাপস বাবুর মাঝে আমরা নজরুলের মতো পত্নীপ্রাণ এক পুরুষকে দেখতে পাই। তাপস-কৃষ্ণা দম্পতির এই প্রেম জগতে অক্ষয় হোক। ক্ষয়িষ্ণু সমাজে অগণন নবদম্পতিদের দিশা দিক তারা। পার্থিব জীবন এমনই প্রেমময় হোক।

লেখক-আশরাফুল ইসলাম : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ।

 

97 ভিউ

Posted ৪:৫৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com