কক্সবাংলা ডটকম(১ ফেব্রুয়ারি) :: গত ৩১ জানুয়ারী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চাঞ্চল্যকর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার মামলার রায় দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে নৃশংসভাবে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করা হয় তা ছিল পরিকল্পিত। এ ঘটনা যেমন সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজকর্মের ওপরও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
অবশ্য এর আগে থেকেই কক্সবাজার বিশেষ করে টেকনাফ অঞ্চলে মাদক চোরাচালান দমনের নামে ব্যাপক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলছিল। যদিও মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমনে একটা শক্ত অবস্থান ছিল। কিন্তু ক্রমাগত মাদক পাচারের নামে হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকায় জনমনে এ প্রশ্ন জেগেছিল- মাদক চোরাকারবারি হত্যার নামে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে কিনা?
মাদক চোরাকারবারি দমনে প্রায় সব ক্ষেত্রেই হত্যার শিকার হচ্ছিল সমাজের দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু মাদক চোরাচালানের পেছনে যেসব রাঘববোয়াল রয়ে গেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড এসব মাদকবিরোধী অভিযানের যৌক্তিকতা এবং এর কলাকৌশল সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
মেজর সিনহা ছিলেন একজন দক্ষ ও চৌকস সেনা কর্মকর্তা। তিনি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হওয়ায় দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের পর তার পছন্দের পেশার তাগিদে বাংলাদেশের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তুতিকল্পে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা মাথায় তার হত্যাকাণ্ড জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। একজন তরুণ সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে এ রকমের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরেও নানা প্রশ্ন, সন্দেহ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দেয়। যেভাবেই আমরা বিষয়টি বিশ্নেষণ করি না কেন তাতে নৃশংসতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তবে সরকার ওই ঘটনায় আশু তদন্ত কাজ শুরু এবং দ্রুত তদন্ত কাজ সমাধানের আশ্বাস দেয়।
শুধু তাই নয়, আমরা দেখেছি, সেনা ও পুলিশপ্রধানের একত্রে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিজ নিজ বাহিনীকে আশ্বস্ত করে। সব মিলে পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এটা প্রথম থেকেই প্রতীয়মান হয়েছে, ওই সময়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলী যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিজেদের কুকর্মের ফল। এর সঙ্গে বৃহত্তর পুলিশ বাহিনী কোনোভাবেই জড়িত নয় এবং এ ঘটনার পেছনে মূল বাহিনীর সহমর্মিতা বা সহযোগিতাও নেই।
বস্তুত সম্পূর্ণ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে অতি দ্রুত চার্জশিট দিয়ে দেড় বছরের সময় বিচারকার্য সম্পাদনের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত- সদিচ্ছা থাকলে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে যে কোনো অপরাধের বিচারিক প্রতিক্রিয়া স্বল্প সময়ে নিশ্চিত করা সম্ভব। উল্লেখ্য, এসব তদন্ত প্রক্রিয়া পুলিশ তার নিজস্ব জনবল দিয়েই সম্পন্ন করেছে। এ ব্যাপারে তাদের প্রশংসা করা যেতে পারে। কিন্তু যেসব প্রশ্ন রয়ে গেল তা হচ্ছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডের আগে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর তদন্ত ও বিচার কি আমরা দেখতে পাব? কারণ স্থানীয় মানুষের এ ব্যাপারে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে, যা আদালত প্রাঙ্গণে তারা সমবেত হয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদকের সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী একটি সংকটের জন্ম দিয়েছে। শুধু মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কখনোই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে এটি সামাজিক সমস্যা। মাদকের চাহিদা থাকলে সরবরাহ আসতেই থাকবে। আমরা জানি, আমাদের যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজ মাদকাসক্ত। আগামী দিনের বাংলাদেশের যারা কাণ্ডারি হতে যাচ্ছে, তারাই যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। একদিকে যেমন জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজকে মাদকের প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে, সেই সঙ্গে মাদকের আমদানি, বাজারজাতকরণের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, একইভাবে প্রশাসন, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকদেরও দায়িত্ব রয়েছে।
আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে আমরা মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তর হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে আবার পরিপূর্ণ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে আইনের সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় যেন না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনী যাদের কাছেই রাষ্ট্র অস্ত্র প্রদান করে থাকে, তাদের সেই অস্ত্রের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকা কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়।
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো কিছুই চাপা থাকে না। যত বিচ্ছিন্ন জনপদই হোক না কেন, ছোট ঘটনাও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বে দেশের ইতিবাচক যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, তাতে যেন কোনো নেতিবাচক অপছায়া না পড়ে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। মেজর সিনহার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এর বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে আমাদের কিছু শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। আমরা একটি সুশৃঙ্খল, আইনানুগ পুলিশ বাহিনী পেতে চাই।
যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সামনের কাতারে ভূমিকা রাখবে এবং বাহিনীর অভ্যন্তরে কোনো রকমের অসাধু ব্যক্তি বা চক্রকে স্থান দেবে না।
বহুল আলোচিত এই ঘটনার মামলার রায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ে ১৫ আসামির মধ্যে ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং সাতজন খালাস পেয়েছেন।
হত্যা মামলার রায় পাঠকালে আদালতের বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত। জনগণ চাইবে, আইনি সব প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীর শাস্তি কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত হোক। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপও প্রত্যাশিত।
লেখক-ইশফাক ইলাহী চৌধুরী :: এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী : নিরাপত্তা বিশ্নেষক; ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি ,অব এশিয়া প্যাসিফিক
Posted ১:৩১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta